আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন তাঁর বহুদিনের। তবে তার চেয়েও বেশি কিছু করার স্বপ্ন ছিল ভারতীয় পাইলট লক্ষ্মী যোশীর। করোনা-পর্বে মানুষের জন্য কিছু করার সুযোগ তাই হাতছাড়া করেননি। কেন্দ্রীয় সরকারের ‘বন্দে ভারত’ মিশনের কাণ্ডারি হয়ে অন্য দেশে আটকে পড়া অসংখ্য ভারতীয়কে নিরাপদে ঘরে ফিরিয়ে এনেছেন মুম্বইয়ের এই কন্যা। বিমান চালিয়ে গিয়েছেন করোনার আতুঁড়ঘর, চিনেও। ঝুঁকি, বিপদ, পাড়া প্রতিবেশীর কথা – কোনও কিছুই কানে তোলেননি কোনও দিন। আকাশের সীমানা ভাঙতে চাওয়া এই সাহসী কন্যার গল্পই আজ শুনে নেওয়া যাক।
ছোট থেকেই আকাশে ওড়ার স্বপ্ন ছিল তাঁর। আট বছর বয়সে প্রথম প্লেনে চড়া। তখন থেকেই মনে মনে জানতেন এই কাজটাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিতে চান তিনি। হতে চান পাইলট। সেই মতো নিয়েছিলেন প্রস্তুতিও।
মুম্বইয়ের বাসিন্দা লক্ষ্মী যোশী। অতিমারী পর্বে ভারত সরকারের ‘বন্দে ভারত’ মিশনের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন লক্ষ্মী। অন্য দেশে আটকে পড়া ভারতীয়দের উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়েছেন এই কন্যা।
২০২০ সালের মে মাস সেটা। আন্তর্দেশীয় উড়ান চলাচলে ততদিনে বিধিনিষেধ জারি করেছে বহু দেশই। বন্ধ অন্য যাতায়াত ব্যবস্থাও। এ দিকে অন্য দেশে কাজ করতে গিয়ে হোক বা অন্য কারণে, করোনার জেরে সেখানেই আটকে পড়েছেন বহু ভারতীয়। তাঁদের উদ্ধার করতে সরকারি ভাবে শুরু হল ‘বন্দে ভারত’ প্রকল্প। আরও অনেক পাইলটের মতোই সেই মিশনে সামিল হলেন লক্ষ্মী।
আরও শুনুন: ইচ্ছাশক্তিতেই আসে সাফল্য, দেশবাসীকে প্রেরণা জোগায় এভারেস্ট জয়ী শিবাঙ্গীর গল্প
সম্প্রতি নিজের সেই অভিজ্ঞতার কথা ভাগ করে নিয়েছেন তিনি। তাঁর হয়ে ওঠার পিছনে সব চেয়ে বড় অবদান তাঁর বাবার। কোনও মতে ধার করে মেয়ের পাইলট হওয়ার খরচ বহন করেছিলেন বাবা। সব সময় সাহস জুগিয়েছেন মেয়েকে। ‘বিয়ে করছে না কেন?’ ‘সংসার কবে করবে?’ – পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজনের এমন হাজারটা প্রশ্নের জবাবে বাবার মুখে সবসময় রেডিই ছিল উত্তর- ‘আমার মেয়ের জন্মই হয়েছে ওড়ার জন্য।’ দু-বছরের কঠোর পরিশ্রমের পরে পাইলট হওয়ার লাইসেন্স পান লক্ষ্মী। মেলে এয়ার ইন্ডিয়ায় চাকরিও।
প্লেন চালানো তাঁর স্বপ্ন। তবে শুধু উড়ানের থেকেও বেশি কিছু করতে চাইতেন লক্ষ্মী সবসময়। সে সময়ই ‘বন্দে ভারত’ মিশনের সুযোগ আসে। স্বেচ্ছাসেবী হয়ে যোগ দেন লক্ষ্মী সেই মিশনে।
শুনে প্রথমে একটু ভয় পেয়েছিলেন বটে বাবা-মা। তবে পরে সাহস জুগিয়েছেন তাঁরাই। অতিমারীর সময় সরকারি ওই মিশনে অন্তত তিনটি বিমান চালিয়েছেন তিনি। প্রথম মিশনটি ছিল চিনের সাংহাইয়ে। সে সময় করোনা নিয়ে আতঙ্ক-ভয়-ভীতি সবটাই ছিল অনেক বেশি। আসেনি ভ্যাকসিনও। তার উপর দেশটা আবার চিন। আর সেটাকে তখন করোনার আতুঁড়ঘর বলেই ধরে নিয়েছে গোটা বিশ্ব। তেমন সময়ই প্লেন উড়িয়ে চিনে পৌঁছন লক্ষ্মী।
সেই অভিজ্ঞতা কোনওদিনও ভোলার নয়, জানিয়েছেন লক্ষ্মী। হ্যাজম্যাট স্যুট পরে থাকতে হয়েছিল পুরো সময়টা। ভারতের মাটি স্পর্শ করার পরে পাইলট ও বিমানকর্মীদের সকলকে উঠে দাঁড়িয়ে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন বিমানযাত্রীরা সকলে। তাঁদের মধ্যে থেকে একটা ছোট্ট মেয়ে লক্ষ্মীর কাছে ছুটে এসে জানায়, তাঁর মতোই হতে চায় ওই একরত্তি। বাবার মতো করেই সেদিন উত্তর দিয়েছিলেন লক্ষ্মী। বলেছিলেন- ‘শেষ সীমানা ওই আকাশ।’
আরও শুনুন: দেশে প্রথম মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা, লড়াইয়ের অপর নাম সাবিত্রীবাই ফুলে
ওই ভারী বর্ম পরে অতক্ষণ ধরে প্লেন চালানোর কাজটা মোটেই সহজ ছিল না। আরও তিন বার ওই সরকারি প্রকল্পের হয়ে প্লেন চালিয়েছেন তিনি। দেশে ফিরিয়ে এনেছেন আটকে পড়া ভারতীয়দের। শুধু তাই নয়, অন্য দেশ থেকে বিমানে করে মেডিক্যাল সাহায্যও দেশে নিয়ে এসেছেন লক্ষ্মী। সেই উড়ানও ছিল তাঁর কাছে খুব অদ্ভুত। যাত্রীর বদলে প্রায় শখানেক কার্টন বক্স নিয়ে ওড়ার অভিজ্ঞতা সেই প্রথম।
‘বন্দে ভারত’-এর কাজ এখনও শেষ হয়নি। দেখতে দেখতে হাজির অতিমারীর তৃতীয় ঢেউ। অন্যান্য় দেশে আটকে পড়া ভারতীয়দের উদ্ধারে এখনও কাজ করে চলেছেন লক্ষ্মীর মতো আরও অনেকেই। নিজের বিপদের কথা না ভেবে তাঁরা যে ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ঝুঁকির মধ্যে, তা অবশ্যই কুর্নিশযোগ্য। শুধু লক্ষ্মীর বাবার কাছেই নয়, গোটা ভারতবাসীর কাছেই আজ গর্ব এই ভারত-কন্যা।