এই তো একটু আগে মানুষটা বাগানে হাঁটছিলেন, নানারকম কথা কইছিলেন। হঠাৎ আমূল পরিবর্তন। এখন সম্পূর্ণ অন্য অবস্থাইয় আছেন। ঠাকুর যেন অন্য কোনও মার্গে বিচরণ করছেন। সেদিকেই নির্নিমেষ তাকিয়ে নরেন্দ্রনাথ। আচমকা ওই অবস্থায় ঠাকুর এগিয়ে এলেন নরেন্দ্রনাথের দিকে। আর তাঁকে স্পর্শ করলেন। আবার ভেসে গেল নরেন্দ্রনাথের মনের সমস্ত দৃঢ়তা। যা কিছু আটঘাট বেঁধেছিলেন সব যেন জলাঞ্জলি হল গঙ্গায়। ঠাকুরের স্পর্শে ফের বাহ্যজ্ঞান লোপ হল নরেন্দ্রনাথের।
বার বার তিন বার; নরেন্দ্রনাথ চলেছেন দক্ষিণেশ্বরে, ঠাকুরের কাছে। এবার অবশ্য আটঘাঁট বেঁধেই এসেছেন। আগেরবার অদ্ভুত পাগল ঠাকুর কী যেন এক জাদু করেছিলেন। কোলের উপর পা-টা তুলে দিলেন। আর তাতেই চোখের সামনে দুলে উঠল গোটা বিশ্ব। এক লহমার সেই ঝড় নরেন্দ্রনাথের মনের ভিতরটা একেবারে ওলট-পালট করে দিয়েছে। যেন আগের নরেন্দ্রনাথ আর আজকের নরেন্দ্রনাথের মধ্য অনেক তফাত। তবে সেদিনই, সেই ঘটনার পরে তিনি মনে মনে ভেবে রেখেছিলেন, এই মানুষটাকে বেশ ভাল করে বুঝতে হবে। আর নরেন্দ্রনাথের স্বভাব হল, একবার যে জিনিসটা মাথার মধ্যে ঢুকে যায় তার শেষ না দেখে ছাড়তে পারেন না। তখন কোথায় যে খাওয়া-ঘুম হাওয়া হয়ে যায়, তার ঠিক নেই। নরেন্দ্রনাথ সেই বিষয়টির প্রতি লেগেই থাকেন। এখন নরেন্দ্রনাথের সব কৌতূহল শুধু ঠাকুরকে নিয়েই। তাই বেশিদিন দূরে দূরে থাকতে পারলেন না। দিন কয়েকের মধ্যেই আবার চলে এলেন দক্ষিণেশ্বরে।
আরও শুনুন- শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৪): ঠাকুর যেন এক রহস্যের খনি, বিস্ময়ে অনুভব করলেন নরেন্দ্রনাথ
সেদিন যখন নরেন্দ্রনাথ গিয়ে পৌঁছলেন, দক্ষিণেশ্বরে তখন ঠাকুরের বেশ কয়েকজন ভক্ত উপস্থিত। এঁদের ভিড়ে নরেনের সঙ্গে আলাপ হবে কী করে! ঠাকুরের যে তাঁর সঙ্গে একান্তে কথা বলা দরকার। ঠাকুর তাই ঠিক করলেন, পাশেই আছে যদুলাল মল্লিকের বাগান; সেখানে নরেন্দ্রনাথকে নিয়ে ঘুরতে যাবেন। যদুল্লাল মল্লিক ঠাকুরের পরম ভক্ত। বাগানের কর্মচারীকে তাঁর আদেশ দেওয়া আছে, ঠাকুর এলে যেন সঙ্গে সঙ্গে বাগান খুলে দেওয়া হয়। আর গঙ্গার ধারে একখানা বৈঠকখানা ঘর আছে। ঠাকুরের বসার জন্য যেন সেটিও খুলে দেওয়া হয়। নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে একান্তে সময় কাটানোর জন্য ঠাকুর এই ঘরটিকেই বেছে নিলেন।
আরও শুনুন: শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৩): ঠাকুর পা তুলে দিলেন কোলে, নরেন্দ্রনাথের সামনে দুলে উঠল গোটা বিশ্ব
গোড়ার দিকে ঠাকুরের সঙ্গে যদুলালের বাগানে ঘুরছেন নরেন্দ্রনাথ। ঠাকুর এটা ওটা প্রশ্ন করছেন। নরেন্দ্রনাথ উত্তর দিচ্ছেন। কিন্তু মনে মনে সতর্ক হয়ে আছেন। কোনো ভাবেই যেন অলৌকিক কিছু না ঘটে। এবার আর সেদিনের মতো ভাবান্তর হলে চলবে না। খানিকটা ঘুরে বেড়িয়ে এবার ঠাকুর সেই ঘরটিতে গিয়ে বসতে চাইলেন। নরেন্দ্রনাথও গেলেন সঙ্গে। বসলেন ঠাকুরের পাশে। একটু সময় যেতে না যেতেই ঠাকুর সমাধিস্থ হয়ে পড়লেন। নরেন্দ্রনাথ দেখছেন তাঁকে অপলকে। আবার যেন আগের দিনের মতোই ফিরে ফিরে আসছে সেই রহস্য। এই তো একটু আগে মানুষটা বাগানে হাঁটছিলেন, নানারকম কথা কইছিলেন। হঠাৎ আমূল পরিবর্তন। এখন সম্পূর্ণ অন্য অবস্থাইয় আছেন। ঠাকুর যেন অন্য কোনও মার্গে বিচরণ করছেন। সেদিকেই নির্নিমেষ তাকিয়ে নরেন্দ্রনাথ। আচমকা ওই অবস্থায় ঠাকুর এগিয়ে এলেন নরেন্দ্রনাথের দিকে। আর তাঁকে স্পর্শ করলেন। আবার ভেসে গেল নরেন্দ্রনাথের মনের সমস্ত দৃঢ়তা। যা কিছু আটঘাট বেঁধেছিলেন সব যেন জলাঞ্জলি হল গঙ্গায়। ঠাকুরের স্পর্শে ফের বাহ্যজ্ঞান লোপ হল নরেন্দ্রনাথের।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২): ঠাকুরের আচরণ দেখে নরেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন মানুষটা ‘অদ্ভুত পাগল’
সেই অবস্থায় ঠিক কী যে হয়েছিল সেদিন, নরেন্দ্রনাথ তা আর জানেন না। কখনও তাঁর স্মরণেও আসেনি। কিন্তু ঠাকুর সবই মনে রেখেছিলেন। নরেন্দ্রনাথ যখন ঘোরের মধ্যে প্রবেশ করেছেন, ঠাকুর তখন তাঁকে চিনে নিচ্ছেন আরও ভাল করে। প্রশ্ন করছেন নরেন্দ্রনাথকে, তিনি কে? কোথা থেকে এসেছেন? এ পৃথিবীতে তিনি কতদিনই বা থাকবেন? ঘোরলাগা অবস্থাতেই নিজের অন্তরে প্রবিষ্ট হয়ে সেই সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন নরেন্দ্রনাথ। তাঁর জবাব শুনে তৃপ্ত হলেন ঠাকুর। এর আগে নরেন্দ্রনাথকে দেখে তিনি যা যা ভেবেছিলেন, তাঁর সম্পর্কে যা যা দেখেছিলেন, নরেন্দ্রনাথের উত্তরে সেই সব কিছুরই প্রমাণ মিলল। আর কোনও সন্দেহের অবকাশ রইল না। ঠাকুর বুঝে নিলেন, যাঁকে তিনি খুঁজছিলেন, যাঁর অপেক্ষায় বসেছিলেন এতদিন, ইনিই তিনি। এই যুবকের শরীর ধারণ করেই এসেছেন সেই জন। তৃপ্ত ঠাকুর তখন নরেন্দ্রনাথের বুকে তাঁর হাতখানা ধীরে ধীরে বুলিয়ে দিতে লাগলেন। ক্রমে ক্রমে চৈতন্য ফিরে পেলেন নরেন্দ্রনাথ।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১): তিনি নররূপী নারায়ণ, এসেছিলেন জীবের দুর্গতি নিবারণে
পরে ঠাকুর বলেছিলেন, নরেন্দ্রনাথ যে কে তা তিনি সেদিনই বেশ ভালো মতো জেনে নিয়েছিলেনন। সব কথা বলতে নিষেধ আছে, তাই খুলে বলছেন না। তবে নরেন্দ্রনাথ নিজে যেদিন বুঝতে পারবেন, তিনি কে, সেদিন আর এ পৃথিবীতে থাকবেন না। দৃঢ়সংকল্পে যোগমার্গে তৎক্ষণাৎ শরীর পরিত্যাগ করে ইহলোক ছাড়বেন তিনি। ঠাকুর খুব স্পষ্ট করেই ভক্তদের জানিয়েছিলেন, নরেন্দ্রনাথ যে সে কেউ নন, তিনি ধ্যানসিদ্ধ মহাপুরুষ।