ইংরেজি মতে বছরটা শুরু হলেও, বাংলা মতে ক্যালেন্ডার কিন্তু অস্তের পথে। কথায় বলে, ‘মাঘের শীত বাঘের গায়ে’। হিসেব মতো পৌষ ফুরিয়ে মাঘে পড়তে না পড়তে আরও বাতাসে হিমের পরশ আরও একটু চড়া হয়। নতুন গুড়ের গন্ধে বাতাস যেন আরও একটু ম ম। বড়দিন, নববর্ষ কাটিয়ে সবে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে ইংরেজি ক্যালেন্ডার, তবে বাংলা মাস জুড়ে উৎসবের বিরাম নেই। আর ক-দিন বাদেই মকর সংক্রান্তি বা পৌষপার্বন। বাঙালির ঘরে ঘরে এ উৎসবের চেনা নাম পিঠেপুলি উৎসব। জিরেন গুড়ের স্বাদ, বাংলার সনাতনী পিঠের আমেজ। সব মিলিয়ে এ পাব্বন গ্রামবাংলার বড় কাছের, বড় প্রাণের। ফসলের গন্ধ মাখা এই মাটির পাব্বনকে কীভাবে পালন করে গ্রামবাংলা? কী কী হয় এই উৎসবে? শুনে নিন।
গঙ্গাসাগরে পুণ্যস্নান থেকে শুরু করে কেঁদুলি মেলা। মকর সংক্রান্তি মানে হাড় কাঁপানো ঠান্ডার সঙ্গে এমন আরও অনেক কিছুই। পৌষ মাসের শেষ দিন মানেই মকর সংক্রান্তি। কোথাও এর নাম পৌষপার্বণ তো কোথাও পিঠেপুলি উৎসব। শুধু বাংলাই নয়, সারা দেশ জুড়েই নানা নামে নানা রীতিতে পালিত হয় এই দিন। তবে গ্রামবাংলার জন্য় যেন এই দিনটা আরও একটু বিশেষ। হবে না-ই বা কেন। এ উৎসব যে আসলে মাটির বড় কাছের, ফসলের উৎসব।
ভারতীয় সভ্যতা প্রথম থেকেই কৃষিনির্ভর। মিশর, গ্রীক বা অন্যান্য সভ্যতার মতো সূর্যের সঙ্গে এ সভ্যতার সম্পর্কও অনেক দিনের। তাই নানা ভাবে নানা পার্বণ-পরবের মধ্য দিয়ে সেই সূর্যের আবাহন জানান ভারতীয়রা। মকর সংক্রান্তিও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে এ উৎসব ফসলের উৎসব। সূর্যের পাশাপাশি সেই উৎপাদনশক্তিকেও আরাধনা করা হয় এ সময়টা জুড়ে। আর সনাতন বাংলায় শস্য মানেই লক্ষ্মী। তাই অনেক জায়গাতেই পৌষলক্ষ্মী পুজোর রীতি রয়েছে। গ্রামবাংলার সনাতন পাব্বন-পরবের সঙ্গে মাটির যোগ বরাবরই অবিচ্ছিন্ন। অঘ্রাণে নবান্নের অনুষ্ঠান হলেও এককালে এই তিথিতেও নবান্ন পালনের রীতি ছিল। এখনও বহু জায়গায় সেই রীতি পালনের প্রথা রয়েছে।
আরও শুনুন: শুধু শীতের আমেজে বিকিকিনি নয়, কোন উদ্দেশ্যে শুরু হয়েছিল পৌষমেলা?
এই সময়টায় গ্রামবাংলায় আউনিবাউনি বলে এক রীতি পালনের নিয়ম রয়েছে। মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে বহু জায়গাতেই এই শস্যোৎসব পালিত হয়। মাঠের পাকা ধান প্রথম ঘরে তুলে আনার দিন হিসেবে উৎসবে মেতে ওঠেন কৃষকের গোটা পরিবার। পৌষ সংক্রান্তির দিন দু-তিনটি ধানের শিষ বিনুনি করে পাকিয়ে তৈরি হয় আউনিবাউনি। শিষ না পেলে দু-তিনটি খড়কেই একত্রে লম্বা করে পাকিয়ে তার সঙ্গে মুলোর ফুল, সরষে ফুল, আমপাতা এ সব বেঁধেই বানিয়ে নেওয়া হয় আউনিবাউনি। আর তা গুঁজে দেওয়া হয় ধানের গোলা, ঢেঁকি, বাক্স-প্যাটরা, তোরঙ্গ বা খড়ের চালে। বছরের প্রথম ফসলই ডেকে আনবে সৌভাগ্য, এমনটাই বিশ্বাস। গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে একটি ঘটে সারা বছর ধরে সংরক্ষণ করা হয় সেই আউনিবাউনি।
আরও শুনুন: বৈশাখ নয়, সেকালে বাংলার নববর্ষ শুরু হত অগ্রহায়ণেই
রাঢ় বাংলার একটা বড় অংশ জুড়ে এই দিনে পালিত হয় টুসু উৎসব। তা-ও একরকম ভাবে ফসল ও মাটির সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত। ধানের তুষ শব্দটি থেকেই নাকি টুসু শব্দের প্রবর্তন। এ রাঢ়বাংলার ঘরের লোকাচার। তাতে না লাগে ব্রাহ্মণ, না লাগে মন্ত্র। টুসু যেন ঘরের মেয়েটি। রঙিন কাগজ দিয়ে বানানো চৌদলের উপরে পোড়ামাটির টুসুকে বসিয়ে গান বাঁধেন ঘরের মেয়ে-বউয়েরা। সেই গানে মিশে থাকে লোকায়ত জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা-হতাশার গল্পও। এক মাস ধরে পুজো চলার পরে মকর সংক্রান্তির দিন নদীতে বিসর্জন করা হয় ঘরের মেয়েকে। তেমনটাই রীতি।
বাকি অংশ শুনে নিন।