এদেশের মাটিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেননি ঠিকই। কিন্তু এই দেশ তাঁকে যেমন গ্রহণ করেছিল আপন সন্তানরূপে, তেমনই তিনিও এই দেশের মাটিকে প্রণাম করেছিলেন আপন মাতৃজ্ঞানেই। সিটার নিবেদিতা, লোকমাতা নিবেদিতা – যে নামেই তাঁকে ডাকি না কেন, তাঁর ভারতদর্শন আমাদের এক অন্য অনুভবের জগতে নিয়ে যায়।
ভারতবর্ষ সাধনার ভূমি। বহু সাধকের সাধনার ধারা এসে মিশেছে এখানে। তাঁদের কেউ এই দেশের মাটিতেই জন্ম নিয়েছেন, আবার কেউ এসেছেন বাইরে থেকে। এই যে ‘বাইরে থেকে এসেছেন’ কথাটি বলা হল, এ আসলে কথার কথা। ইতিহাস-ভূগোল মেনে এরকম বলতে হয় বটে। তবে ভারতবর্ষের যে সাধনা, যা আসলে মানুষের সাধনা, মনুষ্যত্বের সাধনা, – সেখানে ঘর বা বাইরে বলে আর কিছু হয় না। যিনি সাধক তাঁর কাছে এই পুণ্যভূমি চিরকালই আপন আবাস।
সিস্টার নিবেদিতা এসেছিলেন সেরকমই বাইরের ভূমি থেকে। কিন্তু এ দেশকে তাঁর থেকে আপন করে আর কে চিনেছেন! আর ভারতমাতাও তো তাঁকে নিজের সন্তান রূপেই গ্রহণ করেছিলেন। সে অনুভূতির কথা জানিয়েছিলেন নিবেদিতা নিজেই।
আরও শুনুন: ঠাকুর বলতেন, সত্যনিষ্ঠা থাকলে জগদম্বা বেচালে পা পড়তে দেন না…
এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন – “আমাকে যে বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়েছে যা আমাদের স্বজাতীয়দের মধ্যে খুব কম জনের ভাগ্যে জুটেছে তার কথা কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করি। ভারতমাতা আমাকে তাঁর আপন সন্তানের মতো গ্রহণ করে আমার কাছে তাঁর অবগুণ্ঠনমুক্ত রূপটি মেলে ধরেছেন। সাধারণ মানুষের জীবনের অংশভাগী হোয়ার অনুমতি দিয়েছেন। কত যে দয়া করেছেন আমায়! নিজের দারিদ্র্য অথবা পূজাপাট – কিছুই আমার দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে রাখেননি।
তার থেকেই আমার বিশেষ একটি ধারণা হয়েছে যে, এই জাতির বিচিত্র অভ্যাসের, আচার- আচরণের জন্যই অপ্রত্যাশিত ভাবে তাদের মধ্যে মহৎ ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে। এই জাতির চরিত্রের উন্নতির কথা যেভাবেই বলা হোক না কেন, আমি দৃঢ়নিশ্চয় যে, পৃথিবীর যে কোনও জায়গার তুলনায় এখানে নৈতিকতা অনেক বেশি। ‘মহৎ’ বিশেষণটি দিয়ে আমি কোনওরকম বৌদ্ধিক বা দৈহিক দক্ষতা বোঝাতে চাইছি না। বরং আমি এগুলিকে গৌণ বলেই মনে করি। আমি বোঝাতে চাই হৃদয়ের সেই উদারতা, যা মানুষকে ব্যক্তিত্বের ক্ষুদ্র গণ্ডির অনেক ওপরে তুলে ধরে। এবং তাকে গড়ে তোলে মানবতার নতুন প্রবক্তা রূপে।”
আরও শুনুন: মানুষ কি নিজের মন্দ কাজের ভারও ঈশ্বরের উপর চাপাতে পারে?
এই মনুষ্যত্বের সাধনার কথাই তো তাঁকে বলেছিলেন স্বামীজী। একদিন একান্তে জানিয়েছিলেন, ‘ আমার উদ্দেশ্য এই জাতির মধ্যে মনুষ্যত্ব আনা’। সেই পথ ধরেই ভারতবর্ষকে আবিষ্কার করছেন নিবেদিতা। লিখছেন, ‘ ভারতের ধ্যান ও একাগ্রতার কথা উঠলে বলতে হয় – এদেশে মানুষ শিখতে আসে যে – পবিত্রতার অন্তর্নিহিত সক্তি এখানেই রয়েছে – আর সে কথা জানার পর শ্রদ্ধা নিবেদনের একটাই উপায় – মৌন থাকা। যখন সব স্বার্থ , ক্ষুদ্রতা, লোভ নিঃশেষ হয়ে যায় একমাত্র তখনই মানুষ নিজ জীবনাদর্শের বাণীমূর্তি হয়ে ওঠে, তখনই শেখা যায় ত্যাগ কাকে বলে, ভক্তিই বা কী এবং এই ব্যাপারেও ভারতবর্ষের স্থান সকলের ওপরে। খুব সূক্ষ্ম ও উচ্চ আদর্শ না থাকলে এমন মানসিকতা লাভও করা যায় না। আর ভারতীয়দের সেটা পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে। এখানে বেদের প্রভাব তত নয়। রামায়ণ, মহাভারতই এদেশের বাইবেল হয়ে উঠেছে, আর এই মহাকাব্য দুটিকে সকলে জানে। এর এক ভয়ংকর বিপরীত ছবিও আছে। কারণ কর্তব্যের এত উচ্চ ধারণা এখানে দেখি যা বিভিন্ন কর্মকে যেমন অনুপ্রাণিত করে তেমনই আবার বহু লোককে অকর্মণ্য করে দেয়। কিন্তু একটা নিশ্চিত অভিজ্ঞতা লাভ হয়, সেটি হল সর্বদা মহাবীর, ভীম, রাম অথবা যুধিষ্ঠিরের মতো চরিত্রের স্মরণ-মননের ফলে অনেকে নিজেরা উন্নত হয়ে যায়।’
বাকি অংশ শুনে নিন।