ভারতে প্রথম গার্লস স্কুল খুলেছিলেন তিনি। নিচু জাত বলে যাদের সকলে একঘরে করে রাখে, তাদের টেনে এনেছিলেন শিক্ষার আলোয়। জোর গলায় দাবি করেছিলেন সকলের সমান অধিকার। স্বাধীনতার প্ল্যাটিনাম জয়ন্তীতে পৌঁছেও যে কথা সারা দেশের দাবি হয়ে ওঠেনি, সেই কথা বলেছিলেন পরাধীন ভারতের এক নিচু জাতের মেয়ে। আসুন, শুনে নেওয়া যাক সাবিত্রীবাই ফুলের আশ্চর্য জীবনের কথা।
রাস্তায় হাঁটছে এক সতেরো বছরের মেয়ে। আশপাশ থেকে লোকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে নোংরা কাদা, ঢিল, পাথরের টুকরো। ধেয়ে আসছে কদর্য গালাগালি। তবুও হাঁটা থামছে না তার। গন্তব্য তার নিজের হাতে তৈরি করা স্কুল, যেখানে পড়তে আসে নিচু জাতের মেয়েরা। পৌঁছে নোংরা শাড়িটা বদলেই পড়াতে বসে যাবে সে। সতেরো বছরের হেড দিদিমণি। আর মুখের হাসি ধরে রেখেই বলবে, ওদের গোবর, পাথর, আমার গায়ে এসে ফুল হয়ে যায়।
আরও শুনুন: ডাইনি অপবাদ থেকে পদ্ম সম্মান, অন্ধকারে আলো হয়ে জ্বলে ওঠার গল্প শোনান ছুটনি মাহাতো
সেটা ১৮৪৮ সাল। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী যে কলকাতা, সেখানে পর্যন্ত তখনও তৈরি হয়নি মেয়েদের জন্য কোনও স্কুল। সামাজিক ভাবে পিছিয়ে থাকা, নিচু জাত বলে দাগিয়ে দেওয়া মেয়েদের অবস্থার কথা তো না বলাই ভাল। অথচ সেই ভারতেই, পুনে শহরে মেয়েদের জন্য আস্ত একটা স্কুল খোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন সাবিত্রীবাই ফুলে। স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই মেয়েদের আশ্রয় দেওয়ার, গোটা সমাজ যাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সমাজের পিছিয়ে পড়া বর্গ, মুসলমান সম্প্রদায়ের মেয়েদের পড়াতে শুরু করেছিলেন মালি জাতের মেয়ে সাবিত্রী। তার জন্য অবশ্য শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন তিনি ও তাঁর স্বামী জ্যোতিরাও ফুলে। তারপরেও দুজনে গোটা শহরে পোস্টার ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, গর্ভবতী হয়ে-পড়া ব্রাহ্মণ ঘরের বিধবারা যেন ভ্রূণ বা শিশুকে হত্যা করার কথা না ভাবেন। এই দম্পতি জানিয়েছিলেন, তাঁরা ওই অসহায় মেয়েদের পাশে রয়েছেন। পরের কুড়ি বছরে প্রায় ৩৫ জন ব্রাহ্মণ বিধবাকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেন সাবিত্রী। এমনই এক বিধবার গর্ভজাত পুত্রকে দত্তক নিয়েছিলেন তাঁরা। আর সেই ছেলে যশোবন্তের বিয়ে সম্ভবত আধুনিক ভারতের প্রথম অসবর্ণ বিবাহ। সাবিত্রীর ডাকেই একদিনের হরতালে সামিল হয়েছিল পুনে শহরের সব নাপিত। বিধবা হলেই মেয়েদের মাথা কামিয়ে ফেলতে হবে, এই নিয়মের বিরোধিতা করে।
আরও শুনুন: নারীপ্রগতির মশাল জ্বালিয়ে চলে গেলেন কমলা ভাসিন
সাবিত্রীবাই ফুলে এ দেশে মেয়েদের জন্য প্রথম স্কুল বানিয়েছিলেন, ব্রিটিশ সরকারের কাছে প্রতিটি গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করার দাবি তুলেছিলেন, চার বছরের মধ্যেই দলিতদের জন্য তিনটি স্কুল খুলে ফেলেছিলেন, এ সবই সত্যি। কিন্তু সাবিত্রী যে পথে চলেছিলেন, সেই পথ আরও অনেকখানি বড়। উনিশ শতক পেরিয়ে একুশ শতক পর্যন্ত বিস্তারিত হয়ে আছে সেই পথ। সে পথের এক-একটি আলোকবর্তিকা হয়ে আছে মেয়েদের জন্য লড়াই, দলিতের জন্য লড়াই, সর্বোপরি মানুষের জন্য লড়াই। যে দেশে ভিন্নধর্মে ভালবাসার অপরাধে মানুষকে মরে যেতে হয়, সেই দেশের মেয়ে সাবিত্রী নিজের ভাবী পুত্রবধূকে বাড়িতে এনে রেখেছিলেন, যাতে ছেলে ও বউ পরস্পরকে বুঝতে পারে। তাই একুশ শতকের ভারতেও জাতিবৈষম্য কিংবা লিঙ্গবৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে যত আন্দোলন ঘটে চলে, তার একনিষ্ঠ সৈনিক হয়ে হেঁটে চলেন সেদিনের সতেরো বছরের মেয়েটি। ২০২০ সালে মহিলা এবং ট্রান্সজেন্ডার সংগঠনগুলি দেশ জুড়ে যে এনআরসি, সিএএ, এনপিআর বিরোধী প্রতিবাদ মিছিলের ডাক দেয়, তার সঙ্গে জুড়ে যায় সাবিত্রীরই নাম। ইতিহাস বইয়ের পাতায় সাবিত্রী যেটুকুই জায়গা পেয়ে থাকুন না কেন, অপর মানুষদের স্বাধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তাঁর কৃতিত্ব, পরিশ্রম এখনও লড়াইয়ের রসদ জোগায় বহু মানুষকেই।