মানুষ ভাবে, কিছু কিছু কাজ বুঝি কেবল তারাই করতে পারে। অথচ প্রকৃতির এই বিপুল ভাঁড়ার যে কত বিচিত্র তার ঠিক নেই। তাই যে কাজ মানুষ শুধু নিজের বলে ভাবে, দেখা যায়, আরও বহু প্রাণীই সে কাজ করতে পারে। যেমন, মিমিক্রি। সাধারণ কণ্ঠস্বর নকল করার শিল্প হিসাবেই আমরা তাকে চিনি। তবে প্রাণীজগতে তার ধরনধারণ একটু অন্যরকম, এবং প্রাণীরা এই কাজে দক্ষও। আসুন আমরা শুনে নিই।
রাম-সীতার বনবাসকালে সেই ঘটনাটা আমাদের সকলেরই। লক্ষ্মণকে যাতে দূরে সরিয়ে নেওয়া যায় আর সীতাকে একলাটি পাওয়া যায়, সে জন্যই মারীচ দিলেন ডাক। হুবহু রামের কণ্ঠস্বর নকল করে। এতটাই নিখুঁত সেই নকল কণ্ঠস্বর যে, সীতা পর্যন্ত চিনতে পারলেন। তারপরই তো সীতাহরণের পালা। কিন্তু না, রামায়ণের কাহিনিতে আমরা আর ঢুকব না, শুধু এটুকু বুঝে নেওয়ার যে, মিমিক্রি নামক শিল্পটির ইতিহাস কত প্রাচীন। অনেকে বলে থাকেন, এই শিল্পের জন্ম ভারতভূমিতেই। সে কথা থাক। আসলে যে কথা বলার, তা হল, এই শিল্পে যে কেবল মানুষেরই দক্ষতা তা নয়। বলা যায়, প্রকৃতিতে বহু প্রাণীই মিমিক্রিতে দড়। তবে হ্যাঁ, তাদের জন্য মিমিক্রির সংজ্ঞা এবং উদ্দেশ্য- দুইই কিন্তু একেবারে আলাদা।
আরও শুনুন: দত্তক নিয়ে বিয়ের ব্যবস্থা, ৪৭০ জন অনাথ মেয়ের ‘বাবা’ হয়ে উঠেছেন মহেশ
মিমিক্রি বলতে সাধারণত আমরা কণ্ঠস্বরের নকল করাই বুঝি। সমগ্র প্রাণীজগতের দিকে তাকালে অবশ্য এই সংজ্ঞাটি আর একটু প্রসারিত হয়। বলা যায়, মিমিক্রি হল নকল করার শিল্প। মানুষের ক্ষেত্রে কমিউনিকেশন অর্থাৎ সংযোগ-যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রে কন্ঠস্বর খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই হয়তো মানুষের জগতে কণ্ঠস্বর নকলের প্রবণতা বেশি। অন্যদিকে প্রাণীজগতে আবার দেখা যাচ্ছে ভিন্ন ছবি। সেখানে মিমিক্রি বলতে বোঝায়, অন্য একটি প্রাণীর নকল করা, যাতে অনেকের চোখে ধুলো দেওয়া যায়। অনেকের বলতে যাদের থেকে আক্রমণের সম্ভাবনা বেশি। অর্থাৎ প্রাণীটি আছে, কিন্তু শত্রু যাতে তাকে চিনতে না পারে, সেই হিসেবে নিজেকে বদলে নিতে পারে অনেক প্রাণীই। এবং সেক্ষেত্রে তারা নকল করে অপর একটি প্রাণীকেই। প্রাণীসমাজে এটিই হল মিমিক্রি। প্রাণীদের ছদ্মবেশ ধারনের ক্ষেত্রে এই মিমিক্রির একটু সূক্ষ্ম প্রভেদ আছে। আক্রমণকারীর হাত থেকে বাঁচতে কোনও প্রাণী দৌড়ে পালাতে পারে। যাদের সে ক্ষমতা থাকে না তারা প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে থেকে যায়। আর কিছু প্রাণী আছে, যারা অন্য প্রাণীর নকল করে নিজেদের প্রাণরক্ষা করে।
আরও শুনুন: ৩ বছর আগে মৃত্যু তরুণীর, টের পাননি কেউই, পুলিশ দেখেছিল টিভির সামনে বসে কঙ্কাল…
যেমন ধরা যাক ভাইসরয় বাটারফ্লাই নামক এক ধরনের প্রজাপতির কথা। পাকিদের কাছে তারা বেশ লোভনীয় খাদ্য। পাখির চোখে ধুলো দিতে তারা একেবারে অন্য একটি প্রজাপতির রূপ নেয়, যা দেখে পাখিরা বিভ্রান্ত হয়। ততটা সুস্বাদু নয় ভেবে প্রজাপতিটিকে ছেড়ে দেয়, এবং সে প্রাণে রক্ষা পায়। আবার, সাপেদের মধ্যেও দেখা যায় এই প্রবণতা। কোরাল স্নেক বিষাক্ত, সাধারণত প্রাণীরা ছোবল এড়াতে এর থেকে দূরে দূরেই থাকে। এই ধরনের সাপের গায়ে হলুদ, কালো আর লাল রঙের ব্যান্ড দেখতে পাওয়া যায়, যার মধ্যে হলুদ আর লালা থাকে পাশাপাশি। অন্য দু ধরনের সাপ, যারা ততটাও বিষাক্ত নয়, দেখা যায় যারা এই সাপটির নকল করে। তাদের শরীরেও ফুটে ওঠে লাল, কালো আর হলুদ ব্যান্ড। তবে এক্ষেত্রে হলুদ ব্যান্ডের দু-পাশে থাকে কালো রং। কিন্তু রঙের এই বিন্যাস এতটাই কাছাকাছি যে সাধারণত প্রাণীরা খেয়াল করে না। বিষাক্ত ভেবেই তাদের ছেড়ে দেয়।
আরও শুনুন: মানুষের রক্তই তার প্রিয় খাদ্য! আসলে কে এই কাউন্ট ড্রাকুলা?
আবার এক ধরনের মথ আছে, যাদের শরীর থেকে এমন গন্ধ বেরোয়, যা অবিকল মৌমাছির মতো। এমনকী এই মথের কেউ কেউ রানি মৌমাছির মতো শব্দও তৈরি করতে পারে। তাতে বিভ্রান্ত হয় অন্য প্রাণীরা। শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হওয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে, শুঁয়োপোকারা অন্য প্রাণীর নকল করে প্রাণ বাঁচাতে সচেষ্ট হয়। আবার এক ধরনের প্রজাপতির পাখায় থাকে বড় চোখের ছাপ। কোন প্রাণীর চোখ তা বোঝার উপায় নেই, তবে দূর থেকে দেখলে মনে হবে, বড় কোনও প্রাণী তাকিয়ে আছে। তাতেই ভয়ে পিছু হটে আক্রমণকারীরা। এ সবই একদিক থেকে আত্মরক্ষার কৌশল। গিরগিটি বা এই জাতীয় যে সরীসৃপ যেভাবে রং বদলে আত্মরক্ষা করে তাও মিমিক্রিরই একটা অঙ্গ বলা যেতে পারে। সব মিল্যে কণ্ঠস্বরের নকল না হলেও, নিজেদের শর্তে নিজেদের মতো করেই দিব্যি মিমিক্রি করে যায় প্রাণীকুল।