বাংলার ধর্ম-সংস্কৃতিতে শ্রীরামকৃষ্ণ যেন এক নতুন ঘরানা। ঈশ্বরকে তিনি দেখতে শিখিয়েছিলেন নতুন করে। সাধনাকে দিয়েছিলেন নতুন রূপ। ঈশ্বরকে তিনি দেখেছিলেন মানুষের মতো। আর মানুষকে দেখেছিলেন ঈশ্বরের মতো করেই। আসুন শুনে নিই ঠাকুরের সেই ভাবনার কথা।
ঈশ্বর কি শুধু মূর্তির মধ্যে আবদ্ধ! আমাদের ধর্মচর্চা, আমাদের ঈশ্বরসাধনা কি কেবল আচার-সংস্কারের মধ্যে বাঁধা? ভক্তমনে কখনও সখনও এ প্রশ্নের জন্ম হয়। আর যুগের প্রয়োজনে অবতার আবির্ভূত হন সেই সংশয় দূর করার জন্য। এই যুগে আমাদের ঈশ্বরসাধনার অভিমুখ কেমন হবে, তা আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন যুগবতার শ্রীরামকৃষ্ণ।
আরও শুনুন: দুষ্ট লোক অনিষ্ট করতে চাইলে ধার্মিক মানুষের কী করণীয়?
ঈশ্বরকে তিনি দেখতে চেয়েছিলেন মানুষের মতো করেই। এ রীতি তো বহু প্রাচীন। মানুষ তার দৈনন্দিন অভ্যাসগুলিকেই নিয়ে এসেছে ঈশ্বরের সঙ্গে তার ব্যবহারের মধ্যে। তবু ঈশ্বরের সঙ্গে একটা দূরত্ব যেন থেকেই যায়। যেন একটু আলাদা আলাদা করে রাখার প্রবণতা কোথাও কাজ করে। ঠাকুর এই জায়গাটিই মুছে দিয়েছিলেন অনবদ্য এক সিদ্ধান্তে। বহুবার তিনি বলেছেন, সেই পরম ব্রহ্মই সব হয়েছেন। এই বিশ্বে সর্বত্র তাঁরই প্রকাশ। তাই তাঁকে কোনওভাবেই আলাদা করা যায় না। শ্রীগীতাতে ঈশ্বরের যে সনাতন প্রকাশের উল্লেখ আছে, ঠাকুরের কথায় ফিরে ফিরে এসেছে সেই প্রতিধ্বনি। আর-একবার এক ঘটনাতে ঠাকুর এই সারসত্যটি আরও প্রাঞ্জল করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। সেবার শ্রীশ্রী রাধাকান্তজীউর মন্দিরে পুজো হল। পুজো শেষে পূজারী শ্রীমতী রাধারানির বিগ্রহের শয়ন দিলেন। এরপর গোবিন্দের বিগ্রহটিকে তুলে শয়ন দিতে যাবেন, হঠাৎ পা হড়কে পড়ে গেলেন। মেঝেতে জল ছিল। পূজারী খেয়াল করেননি। পা ভাঙল বিগ্রহের। ঘটনায় তো একেবারে হুলস্থুল পড়ে গেল। এক্ষেত্রে কী করণীয় তা স্থির করতে পণ্ডিতদের সভা বসল। সেখানে সিদ্ধান্ত হল যে, ভাঙা মূর্তিকে তো পূজা করা যায় না। তা শাস্ত্রসম্মত নয়। তাই সেই বিগ্রহ বিসর্জন দিয়ে নতুন বিগ্রহ গড়িয়ে নেওয়াই শ্রেয়। সকলেই যখন এ বিষয়ে একমত, তখন মথুরবাবু একবার ঠাকুরের কাছে তাঁর মত জানতে চাইলেন। ঠাকুর সব শুনে অবলীলায় বললেন, রানির জামাইদের মধ্যে যদি কারও পা ভেঙে যেত, তাহলে কি নতুন জামাই আনার ব্যবস্থা হত? নাকি তার চিকিৎসার ব্যবস্থার করা হত! এ যুক্তি অকাট্য। ঈশ্বরকে যদি আমরা আমাদের সত্তার সঙ্গেই মিলিয়ে দেখি, তবে তার বিগ্রহের যা ক্ষতি হয়েছে, তাকে জুড়ে নিয়ে নতুন করে পুজো করা যাবে না, কেন? সে যুগের সকল পণ্ডিত, সকল শাস্ত্রজ্ঞান পেরিয়ে ঠাকুর ঈশ্বরের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে একেবারে নতুন এক দিশা দেখালেন। ভক্ত ও ভগবানের এই যে সম্পর্ক ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করলেন তা যেমন নিবিড় তেমন আন্তরিক। এই আন্তরিকতা থাকলে তবেই তো ঈশ্বর সমীপে যাওয়া যায়। তাহলে তাঁকে আর নানা অছিলায় দূরে দূরে সরিয়ে রাখা কেন! আমাদের ভাবনার জগতে ঠাকুর যেন একটা আলোড়ন আনতে চাইলেন।
আরও শুনুন: ঈশ্বর কি পক্ষপাতী? ভক্তের প্রশ্নের জবাবে কী বলেছিলেন ঠাকুর?
আর উলটোদিকে, মানুষকে তিনি দেখাতে শেখালেন ঈশ্বর করে। নরের মধ্যেই যে আছে নারায়ণ। সে ঈশ্বর হল গণনারায়ণ। এ-ও তো যুগেরই প্রয়োজন। ঝঞ্ঝা-মহামারী ক্লিষ্ট যে যুগের মধ্যে আমরা ঢুকে পড়েছি, সেখানে ঈশ্বরকে কেমন করে দেখতে হয়, তাই-ই আমাদের শিখিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন ঠাকুর। শাস্ত্রজ্ঞান সত্যি, ধর্মাচরণের সমস্ত আঙ্গিকও সত্যি। সে সবের বিরোধী নন ঠাকুর। কিন্তু শুধু সেখানেই আটকে থাকতে চান না তিনি। আমাদের ধর্মবোধকে তিনি আরও একটু প্রসারিত করেন। প্রিয় শিষ্যকে তাই তিনি মন্ত্র দেন, জীবজ্ঞানে শিবসেবার। এ যেন একটা গোটা সময়ের ভিতর থেকে উঠে আসা বাণী, যা আমরা শুনি ঠাকুরের মুখে।
আরও শুনুন: Spiritual: উপবাসেই কি প্রার্থনায় সাড়া দেন ভগবান?
তিনি তো যুগবতার। যুগের প্রয়োজনে মানুষের ধর্ম, মানুষে মানুষে সম্পর্ক, আর মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক কেমন হবে- তার পাঠই দিয়ে গেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ।