এক-একটা জায়গার স্মৃতি জীবনজুড়ে চিতার মতো জ্বলতে থাকে। ছন্দার জীবনে তেমনই আসানসোল।
গরিব বাবা দুই মেয়েকে লেখাপড়া শেখাতে ত্রুটি করেনি। কিন্তু ছন্দা কিশোরবেলাতেই স্কুল ড্রপ আউট। সামান্য গানের গলা, মিমিক্রি করার ক্ষমতা ও অভিনয় করতে পারা— এই তিনটে গুণ আছে দেখে বাবার বন্ধু আরপুলি লেনের গোপীমোহন বসু ওকে চিৎপুরে নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন সাতের দশক। যাত্রার রমরমা। একগাদা যাত্রাদল, বিভিন্ন রঙের হিট পালা। নানা ধরনের শিল্পীর প্রয়োজন চূড়ান্ত। গোপীবাবু সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়েছিলেন।
ছন্দা কোনও দিন নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করতে পারেনি। তবে নিজের বাজার ধরে রাখতে পেরেছিল নানা সাইড রোলে। একটা যাত্রাপালা মানে কত ধরনের মানুষ, কতরকমের হাতছানি, নোংরা হাতের টানাটানি। পয়সার জন্য একে-তাকে দেহের ভাগ দিতে হয়েছে। শরীরের শুচিতা নিয়ে যাত্রাদলে টিকে থাকা যায় না। চিৎপুর পাড়া ছন্দার তখন নাম দিয়েছিল ‘রানিছন্দা’।
ছুটে চলা সে এক জীবন। দুর্গাপুর, রানিগঞ্জ, চিত্তরঞ্জন, বিষ্ণুপুর, জামতাড়া, পুরুলিয়া, আসানসোল। আরও কত ছোটখাটো জনপদে ‘নবমিলন অপেরা’-র এক-একটা পালা আছড়ে পড়ছে। ‘মহারানি লক্ষ্মীবাই’, ‘সাধক বামাক্ষ্যাপা’, ‘কালনাগিনীর ছোবল’, ‘শ্যামলা রঙের বউ’— সব নাম আজকাল মনেও পড়ে না। পিসি, মাসি, সখী, শয়তানি, দুবির্নীতা, ভিখারিনী, বান্ধবী— কত চরিত্রে রানিছন্দার অভিনয়। আগে আগে কয়েকবার দলবদলও করেছিল ছন্দা। তবে সব অপেরার পোস্টারে আর বিজ্ঞাপনে ওর নাম থাকত। মুক্তমঞ্চে, হাজার হাজার দর্শকের মনে একটা দাগ রাখতে পারা চারটিখানি কথা নয়। যাত্রাশিল্পীদের মহলে এটাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। নায়ক-নায়িকাদের কদর ও খাতির ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। বয়স হয়ে যাওয়া ছাড়া তাঁদের প্রতিপক্ষ কেউ থাকত না। তবে প্রতিভার উপর ভর করে কয়েকজন সাইডরোল অ্যাক্টর উঠে এসেছিলেন নায়ক-নায়িকার সমান্তরালে। তাঁদের দিনরাত্রি যেন রাতারাতি বদলে গিয়েছিল।
ছন্দা আর উপরে উঠতে পারেনি। তার পিছনে যে-কারণ দৈব-দুর্বিপাকের মতো, হুড়মুড় করে নেমে এসেছিল ওর জীবনে, তা আজও বহন করে বেঁচে আছে যাত্রার রানিছন্দা।
শারদীয় সংবাদ প্রতিদিন ১৪২৭-এ প্রকাশিত হর্ষ দত্ত-এর গল্প নবমিলন অপেরা-এর নির্বাচিত অংশ।
লেখা: হর্ষ দত্ত
পাঠ: কোরক সামন্ত
আবহ: শঙ্খ বিশ্বাস