রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়-এর কণ্ঠে শারদীয় সংবাদ প্রতিদিন ১৪২৭-এ প্রকাশিত তাঁরই লেখা রম্যরচনা বাঙালির কামসূত্র-র নির্বাচিত অংশ।
বাঙালির আর এক সেক্সগুরু যে প্যারিমোহন সেন, তাতে সন্দেহ নেই। তিনিই তো চিনিয়েছেন আমাদের নারীসুখ। এক এক নারীর কাছে এক এক রকমের আশ্লেষ। এই রকমভেদ তো বাঙালি বাৎস্যায়নের কাছে শেখেনি। শিখেছে প্যারিমোহনের কাছে, রামকৃষ্ণ সেনের কাছে, মহেশচন্দ্র দাসের কাছে। তবে সত্যিই তুলনাহীন প্যারিমোহন। তিনি কলকেতার নারীসুখের ‘ছবি’ লিখেছেন। কলকেতার নারীসুখ কীভাবে এক সাধুকেও গ্রাস করতে পারে, জানাচ্ছেন প্যারিমোহন: ‘আহা! সে কী রূপ!/ ভাবিতে ভাবিতে সাধু ধীরে ধীরে যায়।/ কতরূপ অপরূপ দেখিবারে পায়।’
রামকৃষ্ণ সেন বাঙালি নারী-পুরুষের সেক্সুয়ালিটি তিনি ভারি সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছেন। একেবারে টিপিক্যাল বাঙালি নারী-পুরুষ। ছুটির দিনে দুপুরবেলা পানমুখে বসেছে তারা। কীভাবে পরস্পরকে উত্তেজিত করবে? কাছে টানবে? এ জিনিস বাৎস্যায়ন ভাবতে পারেননি।
ভেবেছেন বাংলা কামশাস্ত্রের প্রাচীন লেখক রামকৃষ্ণ সেন তাঁর ‘বৃদ্ধা-বেশ্যা তপস্বিনী’ গ্রন্থে। প্রথম লাইনেই বাজিমাৎ! নারীটি মুখে পান চিবোতে চিবোতে খুলে দিয়েছে তার বুক। এই মেয়ে ‘রসবতী’, জানাচ্ছেন রামকৃষ্ণ সেন। বোঝে শরীর খেলার সমস্ত আড়াল, সব রস। তা-ই সে রসবতী। এই রসবতী চাইছে ‘ঘৃতাহুতি’, যাতে সে জ্বলে উঠতে পারে। কিন্তু মুখে বলছে না। কোনওরকম ছটফটানি নেই তার। একমাত্র বাঙালি মেয়েই জানে এই গহন সেক্সুয়ালিটির প্রকাশ ভঙ্গি। সেই প্রকাশ তার উন্মোচিত স্তনের রূপে উপচে পড়ছে। কেমন স্তন? পদ্মের মতো। ‘কুচপদ্ম’ লিখেছেন রামকৃষ্ণ।
রসবতীর মন বোঝে বাঙালি পুরুষ। তার মধ্যে কোনও উগ্রতা নেই। যে-উগ্রতা আছে বাৎস্যায়নের পৌরুষ-প্রদর্শনে। বাঙালি পুরুষ খুব নরম করে, আলতো ছোঁয়া রাখে রসবতীর স্তনে। রসবতীর মনে হয়, পুরুষটি যেন পদ্মের মতো সুন্দর, মসৃণ, পরম স্পর্শ রাখল তার স্তনে– ‘এতবলি কুচপদ্মে করপদ্ম দিল।’
তারপরও কোনও তাড়াহুড়ো নেই। একটি অলস শৃঙ্গার-পরিসর তৈরি করেছেন রামকৃষ্ণ সেন, ‘‘পরে পুন পালঙ্কেতে বসিয়া দু’জন/ তাম্বুলাদি আনন্দেতে করিল ভক্ষণ।’’
এই হল বাঙালির কামশাস্ত্র। কোনও হুড়োহুড়ি নেই। কোনও কর্কশতা নেই। অনেক সময় নিয়ে সম্ভোগ। ‘এই রূপে রসরঙ্গে যত যায় দিন/ ক্রমেই তাহাতে আমি হইনু অধীন।’ নারীটি বশ করে ফেলছে পুরুষটিকে তার আপাত অলস অথচ বিস্তারিত যৌনতায়। বুদ্ধদেব বসু হয়তো এই জন্যই লিখেছিলেন, ‘নারীর আলস্যের এরচেয়ে বেশি কিছু পাবে।’
লেখা: রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
পাঠ: রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
আবহ: শঙ্খ বিশ্বাস