সংবাদ প্রতিদিন-এর ‘রোববার’ পত্রিকার জন্মলগ্ন থেকে দীর্ঘদিন সম্পাদক ছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। তাঁর সম্পাদকীয় কলামের পোশাকি নাম ছিল ফার্স্ট পার্সন। এই কিংবদন্তি স্রষ্টার সেই মাস্টারপিস লেখার কিছু নির্বাচিত পর্ব পড়ে শোনাচ্ছেন তাঁরই এক সময়ের সহকর্মী অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। রইল তার প্রথম কিস্তি।
বড় কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি আমরা। একটার পর একটা দিন নতুন করে তীব্র থেকে তীব্রতর কশাঘাতের চিহ্ন রেখে দিয়ে বিদায় নিচ্ছে।
কে পথ দেখাবে? কে দেবে আলো? কে অভয় দিয়ে বলবে— পাশে আছি? সবাই এমন চুপ মেরে গেছে কেন? অগ্রজরা, যাঁরা আদর্শ হয়ে ছিলেন চোখের সামনে; যাঁদের বাক্য–কর্ম–যুক্তি চিরকাল ঈর্ষণীয়ভাবে অনুকরণযোগ্য ছিল, তাঁরা কোথায়? যাঁদের জীবনচর্যা শিখিয়েছে কী করে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হয়, পাড়ি দিতে হয় নৃশংসতম মারের সাগর, তারা চুপ কেন?
বাবা–মাকে বেছে নেবার অধিকার আমাদের নেই। কিন্তু জীবনের পথে চেতনে–অবচেতনে আমরা সবাই তো বেছে নিই কোনও না কোনও অভিভাবক। তাঁরা কোথায়? না কি, তাঁরা সব আছেন পাশেই— আমারই চিনতে ভুল হচ্ছে কেবল?
ঠিক যেন দ্যূতসভায় মৌনী নতমস্তক ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ। ‘ধর্মের গতি অতি সূক্ষ্ম!’ ধর্ম মানে কী? বিশ্বাস, হৃদয়ের ইষ্টমন্ত্র, রাজরোষ, না সারভাইভাল কৌশল?
মৃণালদা, সুনীলদা, শঙ্খদা, সৌমিত্রদা— তোমরা কি প্রবাসে? রীনাদি, গৌতমদা, জয়— তোমরা কথা বলছ না কেন? কোনও কিছুই যেন কোনও কিছুর সঙ্গে মিলছে না।
সিঙ্গুর নিয়ে যে বিতর্কটা শুরু হয়েছিল, আমি বিশ্বাস করি, তার গূঢ় এবং মূল প্রশ্নটি মানবসভ্যতার। কোনও রাজনৈতিক দলের নয়। ‘কৃষিজমিতে শিল্প’ বা ‘ভূমিপুত্র সমস্যা’ থেকে আমরা স্বচ্ছন্দে সরে এসেছি মমতা–বুদ্ধদেবের দ্বৈরথে। কেন?
আমরা কি বিস্মৃত হচ্ছি যে এই বিনোদিনী চাপান–উতোর আসলে বার–বার করে আড়াল করছে এই গ্রহের এই মুহূর্তের গভীরতম বিপর্যয়কে? তবু কেন প্রতিনিয়ত পা দিচ্ছি ঘটনা আর প্রতিঘটনার ফাঁদে?
মহাশ্বেতা দেবী আমার অতন্ত শ্রদ্ধার মানুষ।তিনি যে ভাষায় কথা বলেন, লেখেন, প্রতিবাদ করেন— আমিও যে আদতে সেই ভাষার বাতাবরণে বড় হয়েছি, কেবল এইটুকু ভাবলেই বুক ভরে নিতে পারি গর্বের নিশ্বাস। তিনিও কেন এই আন্দোলনকে মমতা–মুক্ত করতে পারলেন না? একবার বললেন না— ‘না, কোনও ব্যক্তি নয়, সমস্যাটা এই। সেটাকে চেনো।’
মেধা পাটেকর নিশ্চয়ই এই অন্ধকারের মধ্যে এক জ্যোতির্ময়ী আলোকবর্তিনী। নর্মদার সমস্ত স্রোতের শক্তি তাঁর ধমনীতে। বড় ব্যথা লাগে, যখন দেখি তিনিও আফজলের ফাঁসি রদ করার জন্য তার সাত বছরের শিশুপুত্রের টোপ দেন। আমিই যদি জানি, তবে মেধা কি জানেন না যে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবিক প্রশ্ন? অনাথ শিশুর বৈজ্ঞাপনিক প্রয়োগ তার গুরুত্বকে বাড়ায় না, বরং অসম্মান করে।
কমোডিফিকেশন নিয়ে যাঁরা এত সোচ্চার, এত বিদ্রোহী— তাঁরা তো কই একবারও বললেন না যে আবেগের কমোডিফিকেশনও সমান বিভ্রান্তিকর, সামাজিক অনৃতচারণ?
পক্ষে হয়, বিপক্ষে হয়— দয়া করে কিছু বলুন। আমরা সেটাই শুনব। পশ্চিমবঙ্গের জ্যোতিষ্করা নির্বাক হয়ে থাকবেন না, মিনতি করি।
আমরা সাধারণ মানুষ। আবেগ আমাদের যথেষ্ট আছে। এবার আমরা যুক্তি চাই।
সৌরভের প্রত্যাবর্তন আমাদের বাড়ির উৎসব। আমরা ভোট দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচন করিনি, বেছে নিয়েছি গৃহকর্তা।
বিনীত প্রার্থনা, আমাদের নিরাশ করবেন না।
২৪ ডিসেম্বর ২০০৬
লেখা: ঋতুপর্ণ ঘোষ
পাঠ: অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়
আবহ: শঙ্খ বিশ্বাস