সেনার বিশেষ পদে মহিলারা কেন সমান অধিকার পাবেন না? সম্প্রতি এই নিয়েই মামলা হয়েছিল। তাতে শীর্ষ আদালতের সিদ্ধান্তে মিলেছে সুরাহা। রায়ের প্রসঙ্গে মহিলা সেনার রাফাল চালানোর কথা বলেছেন বিচারপতি। ঠিক কী বলেছেন? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে! একথা আলাদাভাবে প্রমাণের প্রয়োজন নেই। সেনা হোক বা ক্রিকেট, নারীর জয়গান সর্বত্র। তবু যেন কিছুক্ষেত্রে লিঙ্গসমতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সম্প্রতি এমনই একটা দিক উঠে এল সুপ্রিম বিচারপতির মন্তব্যে।
ভারত-পাক অশান্তির আবহে চর্চায় ‘অপারেশন সিঁদুর’। আসলে ভারতীয় সেনার অভিযান। তবে যে ঘটনার প্রসঙ্গ ধরে এই অভিযান, কিংবা যে কারণে এর নাম সিঁদুর, তা নিয়ে চর্চার অবকাশ রয়েছে বইকি। চলতি বছরের এপ্রিলে, কাশ্মীরের নৈসর্গিক বৈসরন ভ্যালিতে আচমকা সন্ত্রাসবাদী হামলায় পরিজন হারিয়েছিলেন দেশের মা-বোনেরা। মৃত্যু নয়, বরং আজীবন যন্ত্রণার বাণ বুকে নিয়েই বেঁচে থাকার নিদান দিয়েছিল এই সন্ত্রাসহামলা। ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ তারই ‘প্রতিশোধ’। মে মাসের ৬ তারিখ মধ্যরাত ঘনাতেই, ভারতীয় সামরিক বাহিনী পাকিস্তান ও পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের নয়টি জায়গায় প্রত্যাঘাত করে। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় নয়টি জঙ্গি-ঘাঁটি। পহেলগাঁওয়ে নিরীহ নাগরিকদের হত্যা যেভাবে দেশবাসীকে যন্ত্রণায় বিদ্ধ করেছিল, দেশের সেই ক্ষতে প্রলেপ দিয়েছে ‘অপারেশন সিঁদুর’। ঘটনাশেষে সাংবাদিক সম্মেলনে দেশবাসীর সামনে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর যাবতীয় খুঁটিনাটি তুলে ধরেন ভারতের বর্তমান বিদেশ-সচিব বিক্রম মিশ্রী। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ভারতীয় বিমান বাহিনীর উইং কম্যান্ডার ব্যোমিকা সিং এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল সোফিয়া কুরেশি। এর আগে পর্যন্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের শান্তিরক্ষা বাহিনীর হয়ে বহু কাজে অংশ নিয়েছেন সোফিয়া কুরেশি; অন্যদিকে ২৫০০ ঘণ্টা একটানা উড়ানের অভিজ্ঞতা রয়েছে কম্যান্ডার ব্যোমিকা সিং-এর। ‘অপারেশন সিঁদুর’ পরিচালনার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন এই দুই বীরাঙ্গনা। স্বাভাবিকভাবেই এঁরাও চর্চায়। অপারেশন সিঁদুরের জন্য তো বটেই, সেইসঙ্গে ভারতীয় সেনায় নারীশক্তির প্রতিমূর্ত্তি হিসেবে এঁরা আলোচনায় উঠে এসেছেন। অবশ্য ভারতীয় সেনায় নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাপালন, নতুনকিছু নয়। স্থল-জল-বায়ু তিন ক্ষেত্রে মহিলা কম্যান্ডোর বিভাগ রয়েছে। তবে বায়ুসেনায় মহিলা ক্যাপ্টেনদের সাফল্য বারেবারে চর্চায় ফিরেছে। বিশেষ করে রাফালের মতো যুদ্ধবিমান চালানোয় দক্ষ এমন মহিলা পাইলটের সংখ্যা নেহাতই কম নয়। সুপ্রিম কোর্টে এই বিষয়টাকেই সামনে এনে, সেনার অন্য এক পদে মহিলাদের নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ঠিক কোন বিষয়ে?
তাহলে খুলেই বলা যাক। বিতর্কের কেন্দ্রে ভারতীয় সেনার ‘জাজ অ্যাডভোকেট জেনারেল’ তথা ‘জ্যাগ’ পদ। সেনায় এই পদের রীতিমতো গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু এই পদে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের সুযোগ কম, এমনটাই দাবি ওঠে এক মামলায়। সেনার জ্যাগ পদে নিয়োগ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করেন দুই মহিলা। তাঁদের যুক্তি ছিল, ওই পদে পুরুষদের জন্য বরাদ্দ আসন ছটি, মহিলাদের জন্য তিনটি। এদিকে দুই মহিলা যোগ্যতার বিচারে চতুর্থ ও পঞ্চম স্থান অধিকার করেছেন। সুতরাং পুরুষদের মতো মহিলা পদেও ৬ টি আসন থাকলে তাঁরা নির্বাচিত হতেন। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব হয়নি। এখানেই বৈষম্যের যুক্তি খাড়া করেছেন তাঁরা। দাবি, তাঁরা দুজনেই পুরুষ প্রার্থীদের তুলনায় যোগ্যতায় এগিয়ে থেকেও নির্বাচিত হননি। এই মামলার শীর্ষ আদালতের নির্দেশ দেয়, প্রথম আবেদনকারী আর্শনুর কউরকে (Arshnoor Kaur) জ্যাগ অফিসারের প্রশিক্ষণ শিবিরে পাঠাতে হবে। অন্যজন অর্থাৎ দ্বিতীয় আবেদনকারী চাকরি পাচ্ছেন নৌসেনায়। তবে সেই চাকরিতে তিনি সন্তুষ্ট কি না, সেটাও জানতে চেয়েছে শীর্ষ আদালত। অতএব দুই মামলাকারীর যুক্তিই যে সুপ্রিম কোর্ট মান্যতা দিয়েছে তা বলা যায়। তবে এক্ষেত্রে লিঙ্গসমতার বিষয়টা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন সুপ্রিম বিচারপতি।
আসলে, ২০২৩ সালের পর থেকে জ্যাগ পদে পুরুষ ও মহিলাদের সমান আসন রয়েছে। কোর্টে একথা উল্লেখ করে, জ্যাগ পদে নিয়গ লিঙ্গনিরপেক্ষ বলেই দাবি করেন অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল ঐশ্বর্য ভাটি। পালটা বিচারপতির বেঞ্চ প্রশ্ন করে, যদি যোগ্য মহিলারা নির্বাচিত না হন তাহলে কীসের নিরপেক্ষতা? এই প্রসঙ্গ ধরে নানা বিষয় সামনে আসে। সেনার কিছু পদ যা কেবলমাত্র মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত, সেই তথ্যও সামনে আনা হয়। তবে জ্যাগ অফিসার পদে মহিলাদের নিয়োগ নিয়ে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে, তাতে অদ্ভুত যুক্তি দেয় কেন্দ্র। বলা হয়, মহিলা জ্যাগ অফিসাররা আন্তর্জাতিক সীমান্তে লড়াইয়ের জন্য গেলে শত্রুপক্ষের হাতে বন্দি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এতেই সরব হন সুপ্রিম বিচারপতি। সরাসরি রাফালের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, যদি কোনও মহিলাকে যুদ্ধবিমান ওড়ানোর অনুমোদন দেওয়া হয়, তাহলে জ্যাগ পদে নিয়োগে আপত্তি কীসের? এরপর আর কোনও যুক্তি সেই অর্থে ওঠেনি। সবশেষে নিয়োগের নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত।