তাঁদের দুহাতে লেগে থাকে মাটির গন্ধ। ফসলের বীজে কেবল সার জল নয়, নিজেদের বিন্দু বিন্দু জীবন বুনে গিয়েছেন তাঁরা। আর তাঁরাই এবার এসে দাঁড়ালেন আলোর বৃত্তে। পদ্ম সম্মানে ভূষিত হলেন দেশের দুই কৃষক। তাঁদের যাত্রাকে মর্যাদা জানিয়ে বুঝি সম্মানিত হল দেশও। আসুন, শুনে নেওয়া যাক তাঁদের কথা।
বোকা বুড়োর সেই পাহাড় ভাঙার গল্পটা মনে আছে? সেই গল্পটাকেই একরকম সত্যি করে ফেলেছেন অময় মহালিঙ্গ নায়েক। তিনি অবশ্য সে অর্থে বিখ্যাত কেউ নন। কিন্তু শ্রম, ধৈর্য আর অধ্যবসায়ের নিরিখে তাঁকে হারানো মুশকিল। আদি পেশা ছিল শিউলির। অর্থাৎ তাল-খেজুর গাছে চড়া। নিজস্ব জমিও ছিল না তাঁর। ভাগচাষি হিসাবেই রুজিরোজগার ছিল তাঁর। একসময় মালিকের থেকেই দু-একর জমি পান এই মানুষটি। কিন্তু সেই জমি তো পাহাড়ের ঢালের উপর, সেখানে জল এসে পৌঁছানোর কোনও রাস্তাই নেই। আর জলের জোগান না থাকলে চাষবাস করাও বস্তুত অসম্ভব। কিন্তু হার মানার মানুষ নন মহালিঙ্গ নায়েক। একা একাই পাহাড় খুঁড়ে সুড়ঙ্গ কাটতে থাকেন তিনি। সুড়ঙ্গ কাটা শেষ হলেও কিন্তু জলের দেখা নেই। হাল না ছেড়ে ফের আরেকটি সুড়ঙ্গ কাটতে শুরু করে দেন মহালিঙ্গ নায়েক। একা হাতে সাত-সাতটি সুড়ঙ্গ কাটার পর, অবশেষে তাঁর খেতে জল আসার রাস্তা খুলে যায়। এবার পদ্মশ্রী প্রাপকের তালিকায় নিজের স্থান করে নিলেন ৭৬ বছরের এই অদম্য মানুষটি।
আরও শুনুন: খালি পায়েই পদ্ম সম্মানের মঞ্চে, দেশবাসীকে চমকে দেওয়া এই পরিবেশবিদকে চেনেন?
দেশের সেরা সম্মানগুলির মধ্যে অন্যতম পদ্ম সম্মান। প্রত্যেক বছরই দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে নির্বাচিত কৃতীরা ভূষিত হন এই সম্মানে। তার অন্যথা হয়নি এই বছরেও। আর চলতি বছরের পুরস্কার প্রাপকদের মধ্যেই স্থান করে নিয়েছেন আবদুল খাদের নাড়াকাট্টিন এবং অময় মহালিঙ্গ নায়েক। যাঁরা দুজনেই পেশাগত পরিচয়ে কৃষক। মহালিঙ্গ নায়েকের কথা তো আমরা শুনলাম। এবার শুনে নিই আবদুল খাদের নাড়াকাট্টিনের কৃতিত্বের কথা।
তিনি কেবল কৃষক নন, তিনি উদ্ভাবকের খেতাবও পেতে পারেন অনায়াসেই। কৃষকদের পরিশ্রম কীভাবে খানিক কমানো যায়, এই লক্ষ্যে নিজের সারাজীবন উৎসর্গ করেছেন তিনি। কৃষিকাজকে যাতে যথাসম্ভব সহজ করে তোলা যায়, সেইজন্য বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করে চলেছেন তিনি। নিজে কৃষক বলেই চাষের নানা প্রতিকূলতা সম্পর্কেও তিনি রীতিমতো অবহিত। আর এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েই এ দেশের কৃষকদের শ্রম লাঘব করার ব্রত নিয়েছেন তিনি। নাড়াকাট্টিনের তৈরি করা ফসল বোনার যন্ত্র বর্তমানে বহু কৃষকের উপকারে লাগছে। প্রায় পাঁচ দশকের গবেষণায় এমন একাধিক যন্ত্রের নকশা বানিয়ে ফেলেছেন এই মানুষটি। আর কেবল যন্ত্র বানিয়েই থেমে থাকেননি তিনি। এককভাবে কাজ করার জায়গায় যাতে তাঁর ব্রতকে আরও বিস্তারিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সেই লক্ষ্যে ‘বিশ্বশান্তি এগ্রি-রিসার্চ সেন্টার’ নামে একটি গোটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে ফেলেছেন আবদুল খাদের নাড়াকাট্টিন।
আরও শুনুন: ডাইনি অপবাদ থেকে পদ্ম সম্মান, অন্ধকারে আলো হয়ে জ্বলে ওঠার গল্প শোনান ছুটনি মাহাতো
সাধারণত সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি জগতের কৃতী ব্যক্তিত্ব কিংবা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বেনজির গবেষণার নিদর্শন রাখা মানুষদেরই দেখা মেলে পদ্ম সম্মানের প্রাপক হিসাবে। সেখানে আক্ষরিক অর্থেই মাটির গন্ধ লেগে থাকা এই দুজন মানুষ রীতিমতো ব্যতিক্রম। কৃষিকাজ দেশের প্রধান মৌল চাহিদাটি মেটালেও, কৃষকদের কৃতী হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রচলন কমই। সেই বিরল সম্মান এবার অর্জন করলেন দেশের এই দুজন মানুষ।