বিধ্বংস গাজার ছবি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে পৃথিবীর মাটিতে কতখানি নারকীয়তা ঘটিয়ে তোলা সম্ভব। এ সবই মানবাধিকার লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত। যা প্রতিদিন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে চলেছে। আর তার সাক্ষী থাকছে অসহায় মানুষ। তাহলে, এখন পৃথিবীর কী করণীয়? মানবাধিকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠাই একমাত্র ত্রাতা হতে পারে মানবজাতির, বলছেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর সেক্রেটারি জেনেরাল অ্যাগনেস কালামার্ড।
বহুল প্রচলিত ‘বাটারফ্লাই এফেক্ট’ বলে, এক গোলার্ধে একটি ছোট্ট প্রজাপতি ডানা ঝাপটালে, অন্য গোলার্ধে তার কারণে আকাশভাঙা টর্নেডো নামতে পারে। অর্থাৎ, অতি সামান্য কোনও ঘটনার জেরও যে কতদূর পৌঁছে যেতে পারে, তা আমাদের ধারণার বাইরে। ফলে যদি বলা হয় যে মার্কিন মুলুকে প্রেসিডেন্টের গদিতে বসে ট্রাম্প যখন একের পর এক আধিপত্যবাদী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তখন অন্যদিকে তার জন্য প্রভাবিত হচ্ছে বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন, তবে তা শুনতে অদ্ভুত লাগলেও যুক্তিগতভাবে ভুল হয় না।
গত বছর, মার্কিন মুলুকের নির্বাচন ক্যাম্পেন চলাকালীন একটি কথার অনবরত পুনরাবৃত্তি করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বলেছিলেন, হোয়াইট হাউজ-এ ফিরে এলে মার্কিন তথা বিশ্ব রাজনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন আনবেন তিনি। ট্রাম্পের মতন ‘ডিকটেটর’ আরও একবার ক্ষমতায় ফিরে এলে তা যে বিশ্বে একনায়কত্ববাদের নতুন অধ্যায়ের জন্ম দেবে, সে কথা আঁচ করেছিলেন বহু মানবাধিকার কর্মীই। তাঁদের মতে, এমনটা সত্যি হলে, তা বাইবেলে বর্ণিত ডুমস্ডে-র সমকক্ষ হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন ঠেকানো সম্ভব হয়নি। ট্রাম্প ফিরে এসেছেন ও নিজের দেওয়া কথা রাখতে, প্রকৃত অর্থেই নাটকীয় পরিবর্তন এনেছেন বিশ্ব রাজনীতিতে।
২৯ এপ্রিল, ২০২৫, ট্রাম্প শাসনের নয়া পর্বের ১০০ দিন অতিবাহিত হল। আর প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার মাত্র তিন মাসের মাথাতেই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁর আগের ৪৬ জন প্রেসিডেন্ট যা পারেননি, তাই করে দেখাবেন ট্রাম্প! মুখে বলার চাইতেও হাতে-কলমে করে দেখানোর প্রতি ঝোঁক বেশি এই ‘অল-অ্যাকশন’ সরকারের। বলা বাহুল্য যে, তাঁর নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোর প্রতি সমর্থনই জানাচ্ছেন অন্ধভক্তরা। তবে, বিরোধীরা ভয় পাচ্ছেন এই ভেবে যে, ট্রাম্পের পদক্ষেপের রেশ কেবলমাত্র বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং তার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। অনেকেরই আশঙ্কা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত ‘প্রেসিডেনসি’-র ধারণাকেই আমূল পালটে দেবে ‘ট্রাম্প এফেক্ট’।
মাত্র ১০০ দিন। এরই মধ্যে, অভিবাসী নীতিতে কঠোর হয়েছেন ট্রাম্প। এমনকী আইনমান্যকারী যাঁরা, তাঁদের ভিনদেশের সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আমদানিকৃত সামগ্রীতে চড়া শুল্ক বসিয়েছেন। একদিকে প্রতিবাদী পড়ুয়াদের শায়েস্তা করতে বন্দি করার আদেশ দিয়েছেন, কয়েক হাজার ফেডেরাল কর্মীকে ছাঁটাই করেছেন; অন্যদিকে, এমন অনেককেই মুক্তির আদেশ দিয়েছেন যাঁদের মুক্তি না মেলারই কথা। এর প্রভাব সরাসরি গিয়ে পড়ছে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে। সম্প্রতি তা মনে করিয়ে দিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট।
রিপোর্ট মোতাবেক, ট্রাম্পের এই একশো দিনের শাসনকালই মানবাধিকার রক্ষাকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। পুঁজিনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা একটি চূড়ান্ত রূপ পাচ্ছে এই পর্যায়ে। যার দরুন কর্পোরেট সংস্থাগুলোর হাতের পুতুল হয়ে উঠছে গোটা পৃথিবীর বাসিন্দা। যে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, সেই ব্যবস্থার হাতে কবজা হচ্ছে সাধারণ মানুষ। আর তা কেবল মার্কিন মুলুকে সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপট বিচার করে দেখলে, সারা পৃথিবীই এই ব্যবস্থার অনিবার্য অংশে পরিণত হবে বলে আশঙ্কা এই রিপোর্টে। তাতে কী হবে? আধিপত্যবাদী ব্যবস্থায় প্রান্তিক মানুষের যে দুর্দশা হয়, তাই-ই উত্তরোত্তর বাড়বে। উদারনৈতিক এবং জনকল্যাণকামী ব্যবস্থা থেকে রাষ্ট্র যত কর্তৃত্বের দিকে হাঁটবে, অভিবাসী, পরিযায়ী, নারী, ও প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষ বিপদ তত বাড়বে।
এরই পোশাকি নাম দেওয়া হয়েছে ‘ট্রাম্প এফেক্ট’। যে প্রভাব সম্পর্কে বিশ্বকে সতর্ক করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। মনে করা হচ্ছে, পৃথিবী এর ফলে যেদিকে এগোচ্ছে, তাতে মৃত্যুভয় কিংবা উচ্ছিন্ন হওয়ার ভয়ের মধ্যে বেঁচে থাকাকেই এক সময় স্বাভাবিক বলে মনে করবে বিশ্ববাসী। প্রতিপক্ষকে দমাতে নির্বিচারে হত্যাও হয়তো স্বাভাবিক বলেই গণ্য হবে। গোটা বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেন সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। যেমন, বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন ‘শ্যুট অন সাইট’-এর নির্দেশ; যেমন, মোজাম্বিকে নির্বাচন-পরবর্তী গণআন্দোলন চলাকালীন, এক মহিলার দেহের উপর দিয়ে সেনার গাড়ি চালিয়ে দেওয়া। তুর্কির গণআন্দোলন থামাতে সংবিধানবিরোধী হস্তক্ষেপ করতেও দ্বিধা না করা। সুদানের সিভিল ওয়ার চলাকালীন নারী ও কিশোরীদের উপর বারংবার যৌন হেনস্তা করা। কেননা এই আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়েও স্বৈরাচারের অন্যতম অস্ত্র হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় দুর্বলতর লিঙ্গের উপর অত্যাচারকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে অতি যত্নে যে ‘ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, তা ইতিমধ্যেই টলিয়ে দিয়েছে ট্রাম্প-রাজ। অ্যামনেস্টি জানাচ্ছে, এ কেবল স্বৈরাচারের শৈশবমাত্র। এর প্রভাব গিয়ে পড়বে ভাবীকালে। বিধ্বংস গাজার ছবি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে পৃথিবীর মাটিতে কতখানি নারকীয়তা ঘটিয়ে তোলা সম্ভব। এ সবই মানবাধিকার লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত। যা প্রতিদিন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে চলেছে। আর তার সাক্ষী থাকছে অসহায় মানুষ। তাহলে, এখন পৃথিবীর কী করণীয়? মানবাধিকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠাই একমাত্র ত্রাতা হতে পারে মানবজাতির, বলছেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর সেক্রেটারি জেনেরাল অ্যাগনেস কালামার্ড। তবে, তা এই আধিপত্যের রাজত্বে তা ফিরিয়ে আনা যে কঠিন লড়াই, ট্রাম্প শাসনের এই একশো দিনেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে গোটা পৃথিবীর কাছেই।