চাকরি ছাড়ার পরের একটি বছর প্রতি মাসে স্বাভাবিক নিয়মে বেতন পাঠিয়ে দেবে সংস্থা। অর্থাৎ, সারা বছর কোনও রকম চাকরির সঙ্গে যুক্ত না থেকেও সেই ব্যক্তিকে অর্থকষ্টের মুখ দেখতে হবে না। বরং কাজের দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে সে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে পারে, পছন্দসই খাবার খেতে পারে কিংবা স্রেফ বাড়িতে ঘুমিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু কাউকে অকারণে মাইনে দিলে সংস্থার কী লাভ?
‘কতই না ভালো হত যদি সারা বছর বিশ্রাম নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েও দিব্যি মাসের শেষে মাইনে ঢুকে যেত অ্যাকাউন্টে!’ – ভিড়ভাট্টা ট্রেনে বাসে গলদঘর্ম হয়ে অফিস যেতে যেতে, এমনটা বোধহয় অনেকেই একবার করে ভাবেন। সারা বছর প্রচুর খেটেও দু-একদিনের ছুটির আবেদন প্রায়শই খারিজ হয়ে যায়। তাছাড়া বছরভরের ক্লান্তি কি আর এমনিও মাত্র কয়েকদিনের ছুটিতে মিটতে চায়? সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেও তো কতই এমন লোভনীয় খবর চোখে পড়ে হামেশাই। ‘অমুক কোম্পানি স্রেফ ঘুমানোর বদলে মোটা অঙ্কের বেতন দিচ্ছে কর্মীদের’, ‘তমুক সংস্থা দেবে আপনাকে বিশাল টাকার প্যাকেজ, তার বদলে আপনাকে ঘুরে বেড়াতে হবে দেশ বিদেশ!’ কখনও সেখানে জুড়ে যায় ‘নাসা’-র মতো বড় সংস্থার নাম; কখনও বা দূরদেশের অচেনা কোনও প্রতিষ্ঠানের নামে চালানো হয় এসব গুজব।
তবে যদি বলা হয় যে গল্পকথা নয়, সত্যি সত্যিই এমন একটি কোম্পানি রয়েছে যারা আপনাকে সারা বছর কিচ্ছু না করার জন্য মাইনে দিতে চায়, তাহলে কি বিশ্বাস করবেন? আমরা বলছি বহুজাতিক সংস্থা গুগল-এর কথা, কারণ বাস্তবিকভাবেই কেবলমাত্র বাড়ি বসে থাকার জন্য কর্মচারী পিছু লক্ষাধিক টাকা বেতন বরাদ্দ করেছে এই সংস্থা। পুরোপুরি একটা গোটা বছর সময়মতো আপনার অ্যাকাউন্টে বেতন দিয়ে যাবে গুগল, যার বদলে আপনি সারা বছর যেমন ইচ্ছে সময় কাটাতে পারেন। শুনলে মনে হবে, এ তো প্রতিটি কর্মচারীরই স্বপ্ন সত্যি হওয়ার সামিল! অথচ দেখা যাচ্ছে, গুগল-এর কর্মীরা এমন ধরণের চুক্তিতে সাক্ষর করতে রীতিমত ভয় পাচ্ছেন। কিন্তু কী এমন কারণ রয়েছে এই আপাত সাধারণ চুক্তিটির পিছনে?
গুগল অধিকৃত এআই বিভাগটির নাম হল ‘ডিপমাইন্ড’। ২০১৪ সালে যখন গুগল এর সত্ত্ব ক্রয় করে, তখনও এআই-এর গতিবিধি সম্পর্কে ঠিকমতন ওয়াকিবহাল ছিল না পৃথিবীর মানুষ। এর অধীনে নিয়োজিত রয়েছেন উচ্চপদস্থ এআই ইঞ্জিনিয়ারেরা, যাদের বেতন যে কতখানি ওজনদার, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু আসল গণ্ডগোল শুরু হয় তখন, যখন এই কর্মচারীদের মধ্যে কেউ কেউ পাকাপাকিভাবে কোম্পানি ছাড়বার সিদ্ধান্ত নেন। গুগল প্রথমেই জানিয়ে দেয় যে, চাকরি ছাড়তে কোনও বাধা নেই। তবে চাকরি ছাড়ার পরের একটি বছর এআই ইঞ্জিনিয়ারেরা অন্য কোনও সংস্থায় যোগদান করতে পারবে না। তাহলে এই সময়েকালে সে ব্যক্তির খরচ চলবে কেমন করে? সে চিন্তাও দূর করে গুগল; তাঁরা সদর্পে ঘোষণা করে দেয় যে এই একটি বছর প্রতিটি মাসে স্বাভাবিক নিয়মে ব্যক্তিটির বেতন তাঁকে পাঠিয়ে দিতে থাকবে সংস্থা। অর্থাৎ, সারা বছর কোনও রকম চাকরির সঙ্গে যুক্ত না থেকেও সেই ব্যক্তিকে অর্থকষ্টের মুখ দেখতে হবে না। বরং কাজের দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে সে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে পারে, পছন্দসই খাবার খেতে পারে কিংবা স্রেফ বাড়িতে পড়ে ঘুমাতে পারে। কোম্পানি এই একটি বছর বেতনের বিনিময়ে কিছুই ফেরত চাইবে না তার থেকে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে যে গুগল-এর মতন বৃহৎ সংস্থা কেন এমন কাজ করছে? কাউকে অকারণে মাইনে দিলে তার এতে কী লাভ? এইখানেই নিহিত রয়েছে খেলার আসল অধ্যায়। আমরা যদি একটু চোখ-কান খোলা রাখি, তাহলেই বুঝতে পারবো যে প্রায় আলোর বেগে ছুটছে এআই-এর অগ্রগতি। রাতারাতি নতুন প্রম্পট-এ শিক্ষিত হয়ে উঠছে এআই। ফলস্বরূপ, বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকার ধাঁচ অথবা একেবারে মনুষ্যোচিত লেখার ভঙ্গি রপ্ত করে ফেলছে খুব অল্প সময়ের মধ্যে। এই এআই মডেলগুলি নিয়ে যাঁদের কাজ, অর্থাৎ এআই ইঞ্জিনিয়ার বা এ জাতীয় পদে আসীন ব্যক্তিবর্গের কাছে কর্মক্ষেত্র নেহাত সহজ জায়গা নয়। দ্রুত বদলে যাওয়া প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে যেতে হয় তাঁদের, অন্যথা পিছিয়ে যেতে হয়।
এ অবস্থায় গোটা একটা বছর বসে যাওয়া যে ঠিক কতখানি ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে তাতে একজন উচ্চশিক্ষিত কর্মচারীকে, তা প্রশ্নাতীত। এই একটি বছরের ছুটি কাটিয়ে তাঁরা যখন নতুন কোনও সংস্থায় যোগ দিতে যান, তখন হয়তো তাঁর ঈপ্সিত পদটির জন্য অনেক বেশি কর্মদক্ষতা দাবী করেন আধিকারিকেরা। তাছাড়া ছোট থেকেই মানুষ কেবল একনাগাড়ে দৌড়ে যেতে শেখে। স্কুলের পর কলেজ, তারপর উচ্চশিক্ষা, তারপর চাকরি, একের পর এক উচ্চপদের আকাঙ্খা। এমতাবস্থায় তিনশো পঁয়ষট্টি দিন ধরে অলস বসে থাকলে খুব স্বাভাবিকভাবেই এই ইঞ্জিনিয়ারেরা মানসিকভাবে অনেকখানি পিছিয়ে যান, সরে আসেন ক্রমাগত স্ট্রাগেল করে যাওয়ার মানসিক স্থিতি থেকে। সামাজিক-আর্থিক গতিজাড্য থেকে যেন ছিটকে সরে যান একপ্রকার।
ফলে যা দেখতে লাগে মাত্র এক বছরের ছুটির মতো, তা আদতে গুগল-এর প্রাক্তন কর্মচারীদের সারা জীবনের ক্ষতিসাধন করে দেয়। অনেক চেয়েও কিছুতেই আর তাঁরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন না। ঠিক যেমনভাবে তাজমহল তৈরির পর শাহজাহান কেটে নিয়েছিলেন তাঁর সবচাইতে দক্ষ শ্রমিকদের প্রত্যেকের বুড়ো আঙুলগুলি। দেখলে মনে হবে সামান্য একটি আঙুলের বলিদানই তো শাসক চেয়ে নিয়েছেন কেবল। অথচ বাস্তবক্ষেত্রে দেখতে গেলে, পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্যটি গড়ে সেটির অধিকারী রাজার নাম ইতিহাসের পাতায় পাকাপাকিভাবে জুড়ে দেওয়ার বদলে উপহারে নিজেদের সর্বাঙ্গীণ ক্ষতিই ফেরত পেয়েছিলেন তাঁরা।