“বহুরূপে সম্মুখে তোমা ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর”- সেই কবে এ কথা বলে গিয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস। বলেছিলেন, শিবজ্ঞানে জীবসেবা করার কথা। সম্প্রতি এক মুসলিম দম্পতি যেন মানবতার সেই বাণীটিকেই মূর্ত করে তুললেন। কী করেছেন তাঁরা? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
তীর্থযাত্রায় পরম পুণ্য হয় বলেই বিশ্বাস করেন ধার্মিক মানুষেরা। আর সেই কারণেই ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষদের অনেকেরই জীবনের লক্ষ্য থাকে অন্তত একবার হজে যাওয়া, অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের পবিত্র তীর্থ মক্কা দর্শন করা। ব্যতিক্রম ছিলেন না কেরলের এই দম্পতিও। কিন্তু মানবতার বৃহত্তর লক্ষ্যের দিকে তাকিয়ে সেই ব্যক্তিগত স্বপ্নকে মুছে ফেললেন তাঁরা। পরিবর্তে মানবসেবার মধ্যে দিয়েই যেন খুঁজে নিলেন ধর্মের পরমার্থ।
আরও শুনুন: জ্ঞানবাপী বিতর্কে ক্ষতি হচ্ছে ব্যবসায়, রুজির প্রশ্নে একজোট হিন্দু-মুসলমান ব্যবসায়ীরা
কেরলের জেসমিন আর হানিফার আজীবনের স্বপ্ন ছিল, হজে যাওয়া। কিন্তু দূরত্ব, খরচ ইত্যাদি কারণে অনেক মুসলমানের পক্ষেই এই ইচ্ছা পূরণ করা সম্ভব হয় না। এই দম্পতিও দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের ইচ্ছেকে মনে মনেই বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। দীর্ঘ ৩০ বছরের বিবাহিত জীবন কাটিয়েও এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব হয়নি তাঁদের পক্ষে। অবশেষে তাঁরা ঠিক করেছিলেন, হজে যাওয়ার খরচ জোগাড় করতে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমিটি বিক্রি করে দেবেন তাঁরা। ১২ হাজার স্কোয়ার ফুটের সেই জমিটি বিক্রি করলে হজে যাওয়ার খরচ উঠে আসবে অনায়াসেই, এমনটাই মনে করেছিলেন ওই দম্পতি। কিন্তু ঘটনাচক্রে সেই ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার আগেই বদলে গেল পরিস্থিতি।
কী ঘটেছিল? হানিফা জানিয়েছেন, তাঁরা যখন জমি বিক্রির জন্য ভাবনাচিন্তা শুরু করেছেন, সেই সময়ে এলাকার একটি বিষয়ের দিকে তাঁদের নজর পড়ে। তাঁরা খেয়াল করেন যে, বিগত কয়েক মাস ধরে ওই এলাকার কোনও কোনও বাসিন্দাকে রীতিমতো সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। ওইসব মানুষদের কোনও নিজস্ব জমি ছিল না। আর সেই কারণে, পরিবারের কোনও সদস্যের মৃত্যু হলে তাঁকে কবর দিতে সমস্যায় পড়ছিলেন বাকিরা। এই পরিস্থিতিতে নিজেদের হজ যাত্রা ও তার অর্থসংস্থান নিয়ে ফের চিন্তা করতে শুরু করেন ওই দম্পতি।
আরও শুনুন: হিন্দু রাজার জমিতেই গড়ে উঠেছিল তাজমহল, কীসের বিনিময়ে পেয়েছিলেন শাহজাহান?
এই সময়েই তাঁদের কাজটা সহজ করে দেন এক স্থানীয় মোড়ল। এমনই একটি ভূমিহীন পরিবারকে কিছু পরিমাণ জমি দানপত্র করে দেন তিনি, যাতে তারা বাড়ির মৃত মানুষটির সৎকার করতে পারে। এই কাজ দেখে আর দেরি করেননি জেসমিন ও হানিফা। তাঁদের অধিকারে থাকা ১২ হাজার স্কোয়ার ফুটের সম্পূর্ণ জমিটিই তাঁরা সরকারের ‘লাইফ মিশন’ প্রকল্পে দান করে দেন। ভূমিহীন মানুষদের জন্যই গৃহনির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে কেরল সরকারের এই প্রকল্প।
যেখানে ধর্মের জের টেনে উত্তাল হয়ে উঠছে সারা দেশ, এক পক্ষ অপর পক্ষের পায়ের তলা থেকে জমি সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে, সেখানে অভিনব দৃষ্টান্ত তৈরি করলেন কেরলের ওই দম্পতি। নিজেদের আজীবনের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়েও যেভাবে মানবতার উদযাপন করেছেন তাঁরা, তাকে কুর্নিশ জানাচ্ছেন সকলেই।