অজ্ঞতা থেকে অভিজ্ঞতার দিকে যাওয়ার যাত্রাপথে, পরিজন হারানো শিশুটি বুঝতে শেখে যে, তার পরিবারের মানুষটির দেহত্যাগের ঘটনা কোনও সাধারণ মৃত্যু নয়। বরং দেশের জন্য অত্যন্ত গর্বের। দেশের সেনাবাহিনীর যে কোনও সদস্যের মৃত্যুই যে আদতে বৃহত্তর মঙ্গলের স্বার্থে, তা সে বুঝতে শেখে ধীরে ধীরে। সমাজের শেখানো সহজ হিরো-ভিলেনের সমীকরণ তাকে বোঝায় যে, দেশের শত্রু তারও শত্রুই।
যুদ্ধে সবথেকে ক্ষতি হয় কার? রাষ্ট্রের কাছ এ-প্রশ্নের উত্তর একরকম। ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান দিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করলেই বোঝা যাবে, ক্ষতির পাল্লা কোনদিকে ভারী। তবে যুদ্ধের ক্ষত আর ক্ষতি সবথেকে বেশি আহত করে শৈশবকেই। যুদ্ধের সবথেকে নৃশংসতা বোধহয় শৈশবের অপমৃত্যুই। আক্ষরিক মৃত্যু ন আহলেও, যুদ্ধে রত দেশের শিশুর শৈশব বদলে যায় এক লহমাতেই। সেই বদল যে ক্ষতি বয়ে আনে, সে-ক্ষতি আগামীর পৃথিবীরই। আর তাই ভারত-পাক সংঘাত আপাতত থামলেও, শিশুমনে যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে চিন্তা-ভাবনার প্রাসঙ্গিকতা থেকেই যাচ্ছে।
এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে রাখা- নবজাতকের কাছে এই অঙ্গীকারই করতে চায় প্রাচীন পৃথিবী। তবে, মানুষ নিজেই নিজের ইতিহাস রচনা করলেও সবটা তার হাতে থাকে না। আর তাই কখনও না চাইলেও এসে পড়ে যুদ্ধের ইতিহাস। সবরকম ভয়াবহতা নিয়েই আসে যুদ্ধ। যুদ্ধ যে মৃত্যু ডেকে আনে, তা একদিকে যেমন দেশের, তেমনই তা পারিবারিকও বটে। ফলত যে শিশু তার পরিজনকে হারাচ্ছে, তার মনে প্রভাব পড়ে অন্য মাত্রাতেই।
সাম্প্রতিক এক ঘটনার কথাই ধরা যাক। চলতি ভারত-পাক সংঘর্ষের জেরে শহিদ হয়েছেন ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্স-এ নিযুক্ত সারজেন্ট সুরেন্দ্র মোগা। শহিদকে সম্মান জানাচ্ছে গোটা দেশ। প্রাণ দিয়ে তিনি যেভাবে দেশ রক্ষা করেছেন, তার জন্য গর্ব অনুভব করছেন দেশবাসী। তবে এর প্রভাব তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাছে কেমন? শহিদের এগারো বছর বয়সী কন্যা বর্তিকা জানিয়েছে, বাবার আত্মত্যাগে সে যারপরনাই গর্বিত। এবং তার জীবনের লক্ষ্য, বড় হয়ে বাবার হত্যার বদলা নেওয়া। এই ‘বদলা’ তো কিছুদিন আগে দেশের অধিকাংশ মানুষই চাইছিলেন। চাইছিলেন পহেলগাঁও হত্যার জবাবে প্রত্যাঘাত হানুক ভারত। সেই পথেই এসেছে ‘অপারেশন সিঁদুর’, এবং তারই ফলশ্রুতি সুরেন্দ্র মোগা-র আত্মাহুতি। কিন্তু দেশের মানুষ সার্বিক ভাবে যে বদলা চাইছেন, আর শহিদকন্যা যে বদলা মনে লালন করছে, দুয়ের মাত্রা অনেকটাই আলাদা হয়ে যায়। দুই ক্ষেত্রে দেশই কেন্দ্রীয় ভূমিকায়, তা সত্ত্বেও একটি একান্ত ভাবেই পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত।
ঠিক এখানেই ভাবনার অবকাশ থেকে যায়। যুদ্ধবিরতির আগে পর্যন্ত গোটা দেশ জুড়ে চলছিল যুদ্ধ-আবহ। অনেকেই যুদ্ধ চাইছেন। যাঁরা এর বিরোধিতা করছেন, তাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন। তারস্বরে চতুর্দিকে চলছে যুদ্ধের ধারাবিবরণী, ধ্বংসের খতিয়ান ফিরছে মানুষের মুখে মুখে। রাষ্ট্রীয় স্তরে এর গুরুত্ব এক রকম। এইসব আলোচনার ভিতর সম্ভবত যা খেয়াল করা হয় না, তা হল, এই যুদ্ধের কথাবার্তা শিশুমনে কী প্রভাব ফেলছে। বা, পরিজন হারানোর ব্যক্তিগত শোক যাঁদের বুকে বাসা বাঁধছে, তাঁদের কাছে যুদ্ধের গুরুত্ব কীরকম! এমনকী যাঁরা যুদ্ধ চান না, তাঁদের কাছেও যুদ্ধের আলোচনা যে ভয়াবহতা ডেকে আনছে তার প্রভাব কতখানি। আলোচনা বহু স্তরেই হওয়া উচিত, তবে, এর মধ্যে সবথেকে উদ্বেগজনক বোধহয় শিশুদের ক্ষেত্রটিই। কেননা প্রাপ্তবয়স্কেরা হয়তো কতদূর মনে রাখবেন আর রাখবেন না, কী নিয়ে মাথা ঘামাবেন আর ঘামাবেন না তা পৃথক করতে পারেন। ছোটরা পারে না। ফলে এই বদলা বা প্রত্যাঘাত বুকে নিয়েই তারা বেড়ে ওঠে।
অজ্ঞতা থেকে অভিজ্ঞতার দিকে যাওয়ার যাত্রাপথে, পরিজন হারানো শিশুটি বুঝতে শেখে যে, তার পরিবারের মানুষটির দেহত্যাগের ঘটনা কোনও সাধারণ মৃত্যু নয়। বরং দেশের জন্য অত্যন্ত গর্বের। দেশের সেনাবাহিনীর যে কোনও সদস্যের মৃত্যুই যে আদতে বৃহত্তর মঙ্গলের স্বার্থে, তা সে বুঝতে শেখে ধীরে ধীরে। একই সঙ্গে শত্রুপক্ষের সম্পর্কে ধারণা জন্মায় তার মনে। সমাজের শেখানো সহজ হিরো-ভিলেনের সমীকরণ তাকে বোঝায় যে, দেশের শত্রু তারও শত্রুই। আপাত ভাবে এ সমীকরণে ভুল নেই কোনও। কিন্তু যুদ্ধ-আবহের সঙ্গে শৈশবেই পরিচিত হয়ে যাওয়া কি আগামীদিনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি অশান্তির পথ প্রশস্ত করে দেয় না? অর্থাৎ যে বদলানো মন নিয়ে এই শিশুরা বেড়ে উঠছে, সেখানে যুদ্ধ এড়িয়ে মানবতার দিকে যাওয়ার ভাবনা কি আর সঙ্গত বলে মনে হতে পারে? এ প্রশ্ন থেকেই যায়।
ইতিহাস বলছে, হিরোশিমা-নাগাসাকি হোক, কিংবা ইউক্রেন-গাজার মতো হাল আমলের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরাই। সমীক্ষা জানাচ্ছে, এই শিশুরা ব্যাপক হারে উদ্বেগ, ডিপ্রেশন, পিটিএসডি-র মতো হাজারও মানসিক ব্যধির শিকার হয়। তাদের মধ্যে হিংসাপ্রবণতা প্রবল। ক্ষমা দুর্বলতা বলেই প্রতিপন্ন হয় তাদের কাছে। তারা অন্যকেও ক্ষমা করতে পারে না যেমন, তেমনই নিজের প্রতিও অত্যন্ত হিংসাত্মক ব্যবহার করে থাকে। হত্যা ও আত্মহত্যা দুই-ই সহজ বলে মনে করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের শিশুরা। ফলত বলা যেতে পারে যে, বাইরের যুদ্ধ মিটে গেলেও এই শিশুরাই ভিতরে ভিতরে যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ বয়ে বেড়ায়। এবং পরবর্তীকালে সুদূর ভবিষ্যতে পরবর্তী যুদ্ধের সম্ভাবনাকে বাঁচিয়ে রাখে তারাই।
তাই রাষ্ট্রস্তরে যুদ্ধবিরতি চললেও, মন বদলের যুদ্ধ থামল কি-না, সে খোঁজ নেওয়াও জরুরি। শিশুদের নির্মল শৈশব দিতে না পারলেও, যুদ্ধের উন্মাদনা থেকে যাতে তাদের আড়ালে রাখা যায়, তা নিশ্চিত করার দায় বড়দেরই।