খিদে মানুষকে বিপন্ন করে বলেই, সেই খিদেকে হাতিয়ার করেই মানুষকে অন্য বিপন্নতার পথে ঠেলে দেওয়া চলে। কেন-না খিদে তো অতশত বোঝে না। সে কেবল ক্ষুধার অন্নটুকুই চেনে। আর সে অন্ন যে এগিয়ে দিচ্ছে, সেই হাতকে সে বিশ্বাস করে চোখ বুজে। নুন খেলে গুণ গাইতে হয়, খাদ্য দেওয়া-নেওয়ার সঙ্গে এই বিশ্বস্ততাই জড়িয়ে আছে প্রবাদ হয়ে। সেই অন্নের সঙ্গে কোনও বিপদ জড়িয়ে আছে কি না, তা ভেবে দেখার মতো বিলাসিতা ক্ষুধার্ত মানুষ করতে পারে না।
দুটি অন্নের প্রত্যাশায় ঘরে এসে দাঁড়িয়েছেন কোনও মানুষ। পরিবার পরিজন নেই, নেই টাকাকড়ি সম্বল। এর ওর দোরে দু-মুঠো জুটে গেলে দিনেকের নিশ্চিন্তি মেলে। সেই মানুষকে সযত্নে খাবার বেড়ে দিচ্ছে কেউ। বসিয়ে খাওয়াচ্ছে। ক্ষুধার তাড়সে গোগ্রাসে মিলিয়ে যাচ্ছে খাবার। পেটভরা খাবার সেই মানুষটিকে বিশ্বাসে, নির্ভরতায় শিথিল করে তুলছে। আর সেই সময়েই, নেমে আসছে আঘাত। এতক্ষণ যে ছিল অন্নদাতা, সে-ই ডেকে উঠছে- ‘বাতাপি!’ আর, এইমাত্র খাদ্যের শান্তি জড়িয়ে নেওয়া মানুষটির জঠর ছিন্নভিন্ন করে বেরিয়ে আসছে বাতাপি নামের সেই রাক্ষস। অন্যজন, ইল্বল, সেও রাক্ষসের সত্তায় ফিরছে এইবার। এক নিরীহ বুভুক্ষু মানুষকে খাদ্যের টানে ভুলিয়ে, তারপর হত্যা করে হাসিতে ভেঙে পড়ছে তারা।
আরও শুনুন:
এ কাহিনি রামায়ণের। ইল্বল আর বাতাপির কাহিনি। সম্প্রতি খাদ্যের সঙ্গে জড়িয়ে যে খুনের ঘটনাটি আমাদের অসাড় করে দিয়েছে, যেখানে এক সহায়-সম্বলহীন মানুষকে ভাত খাইয়ে নির্দ্বিধায় মেরে ফেলেছে আরও কিছু মানুষ, যাদের মুখগুলো সেসময়ে হয়তো আর মানুষের মতো দেখাচ্ছিল না; সে ঘটনার কথা বলছি না। কিংবা, বলছিও হয়তো। আসলে খিদে তো মানুষের সবচেয়ে বড় বিপন্নতার নাম। যে বিপন্নতা একালের, সেকালের, বরাবরের জন্য শাশ্বত। খিদে মানুষকে বিপন্ন করে বলেই, সেই খিদেকে হাতিয়ার করেই মানুষকে অন্য বিপন্নতার পথে ঠেলে দেওয়া চলে। কেন-না খিদে তো অতশত বোঝে না। সে কেবল ক্ষুধার অন্নটুকুই চেনে। আর সে অন্ন যে এগিয়ে দিচ্ছে, সেই হাতকে সে বিশ্বাস করে চোখ বুজে। সেই অন্নের সঙ্গে কোনও বিপদ জড়িয়ে আছে কি না, তা ভেবে দেখার মতো বিলাসিতা ক্ষুধার্ত মানুষ করতে পারে না। এই ভরসাটুকু আদতে অন্নের মতোই পবিত্র, সৎ। তাই, সে বিপন্নতাকে পুঁজি করেই অসহায় মানুষকে অন্যভাবে বিপন্ন করে তোলার যে নির্মমতা, তা বোধ করি তুলনাহীন। মহাকাব্যে যে নির্মমতার আখ্যান ছিল, বাস্তবে সেই নির্মমতাকেই নতুন করে চিনতে হল আমাদের, এই ঘটনার সূত্র ধরে।
আরও শুনুন:
বাবার গল্প: সন্তানের মৃত্যুশয্যায় হেঁটে পৌঁছতে পারেননি যে বাবা
মহাকাব্যের নির্মমতা যে যুগের পর যুগ পেরিয়েও এভাবে সত্য হয়ে রইল, তার কারণ সেই নির্মমতার প্রেক্ষাপট এখনও জারি রয়ে গিয়েছে। সে প্রেক্ষাপট মানুষের খিদে। রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্য সংস্থার তরফে ২০২৩ সালের শেষ দিকে জানানো হয়েছিল, ৫০টি দেশে ৪ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ দুর্ভিক্ষের ঠিক আগের অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন। পাঁচ বছরের কম বয়সি সাড়ে চার কোটি শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। পৃথিবীতে এই মুহূর্তে ৭০ কোটি মানুষ জানেন না, তাঁরা আবার কখন খেতে পাবেন বা আদৌ পাবেন কি না। প্রতি দশজনে একজন মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাতে ঘুমোতে যান। চাঁদে মানুষ পাঠানোর এই আকাশছোঁয়া উন্নতির যুগেও। মনে করে নেওয়া যাক, অতিমারির পর প্রকাশ্যে আসা কেনিয়ার সেই মহিলার কথা। যাঁর স্বামী তার আগের বছরই খুন হয়েছেন। কেনিয়ার মোম্বাসায় আট সন্তানকে নিয়ে বেঁচে থাকা সেই মা, প্রতি রাতে আগুনে ডেকচি বসাতেন, আর ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতেন, খাবারের আশায় আশায় কখন সেদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়বে ছেলেমেয়েরা। কারণ মা-ই শুধু জানেন, হাঁড়িতে ফুটছে শুধু জল। আর ক’টা নুড়িপাথর! আমাদের মনে পড়ে যায় ‘নবান্ন’ লেখার প্রেক্ষাপট বলতে গিয়ে বিজন ভট্টাচার্যের সেই অভিজ্ঞতার কথা, যেখানে সারাদিনে সামান্য ফ্যান জোগাড় করতে পেরে তা-ই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কাড়াকাড়ি করে খেয়ে ফেলে মা নিজে। ওইটুকু সম্বল পেয়ে পেটের আগুন যখন একটু থিতিয়ে আসে, তখন সেই মা-ই হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে, কী করেছে বুঝতে পেরে। দুর্ভিক্ষের পটভূমিতেই দাঁড়িয়ে থাকা ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে মাছের ঝোল ভাত বলতে বলতে মেয়েটি মরে যায়। তার জীবনের শেষ ইচ্ছে হয়ে থাকে মাছের ঝোল আর ভাত। এসবের থেকে আরও কয়েক দশক এগিয়ে এসেও, সেই একই খিদে জেগে থাকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘গরম ভাত অথবা নিছক ভূতের গল্প’-এ। যেখানে দিনের পর দিন খেতে না পাওয়া বৃদ্ধ, ডাক্তারের বদান্যতায় পাওয়া ভিটামিন ট্যাবলেট চিবিয়ে খায়। সেই না-খেতে পাওয়ার বিপন্নতায় ভাতের ডেকচি কেড়ে খেতে চায় বানভাসি বাদা থেকে আসা লোকটি। মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ গল্পের সেই মানুষ, বানের জলে তার ঘর ভেসে গিয়েছে, ভেসে গিয়েছে স্ত্রী-সন্তান, কেবল জেগে আছে একপেট খিদে। নব্বই-পার বুড়োকর্তার আয়ু বাড়ানোর যজ্ঞে ভোজের বিপুল আয়োজন, সেখানে খাটতে এসে সে কেবল ভাতের গন্ধ বুক ভরে নেয়। আর কর্তার মৃত্যুতে সমস্ত খাবার ফেলে দেওয়ার নির্দেশ এলে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে সেই ভাতের ডেকচিটাই। ভাতের ভার নিয়ে ঘুমিয়ে পড়া সেই মানুষকে ডেকচি চুরির অপরাধে পুলিশে ধরে যখন, তখনই ফের স্পষ্ট হয়ে যায়, খিদে নিজেই এমন এক বিপন্নতা, যে মানুষকে নানাভাবে কেবল বিপন্নই করে চলে।
আরও শুনুন:
দল বা কোন্দল নয়, ভয় না পাওয়াই রাজনৈতিক
বাদা থেকে আসা সেই মানুষটি ভাত পায়নি। যেমনটা বাদার আরও অনেক মানুষ পায় না। ধনী বাড়িতে বাদা থেকে নানারকমের চাল এসেছে শুনে তাই সে খুঁজতে চেয়েছিল, সেই বাদাটা কোথায় যেখানে প্রভূত চাল মেলে! আসলে ক্ষুধার্ত মানুষের তো প্রশ্ন তোলার সংকুলান নেই। জনসাধারণের করের টাকায় শাসকের নামাঙ্কিত বদান্যতা যখন রেশনের রূপ ধরে আসে, মুফতে পাওয়ার কৃতজ্ঞতা বা বাধ্যবাধকতায় তাঁরা প্রশ্ন তুলতে সাহস করেন না, তাঁদের কতটুকু পাওয়ার কথা এবং কতটুকু পাচ্ছেন তা নিয়ে। রাষ্ট্রপুঞ্জ যদিও বলে, খাবার না-পাওয়ার পিছনে খাদ্যাভাব নয়, আরও বেশি দায়ী অন্যান্য কারণ। রাষ্ট্রপুঞ্জের তথ্য অনুসারে, যে দেশগুলি দীর্ঘ দিন ধরে যুদ্ধ ও অভ্যন্তরীণ সংঘাতে দীর্ণ, তাতে ক্ষুধা করাল রূপ নিয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের যে ৩৬টি দেশ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন; সুদান, ইয়েমেন, কঙ্গো, আফগানিস্তানের মতো সেই দেশগুলির অধিকাংশই দীর্ঘ দিন অশান্ত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলছে। আবার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দুর্ভিক্ষের উদ্ভব হতে পারে না বটে, কিন্তু অর্ধাহার, অপুষ্টির নীরব মহামারি চলতেই থাকে, আর তাকে অস্বীকার করেই সংকটকে দীর্ঘায়িত করে রাষ্ট্র। খিদে নামে মানুষের এই দীর্ঘমেয়াদি বিপন্নতাকে জিইয়ে রেখে আসলে কাদের খিদে মিটছে, সে প্রশ্ন আর কবে করব আমরা?