দিল্লি সীমান্ত সিংঘুতে কৃষি আইনের প্রতিবাদে রাম সিংয়ের আত্মহত্যা জাতীয় রাজনীতির রক্তস্রোত হিম করেছে। শিখ ও কৃষক ভাবাবেগে ঘৃতাহুতি পড়েছে বলে অনেকের অভিমত। গুরুদ্বারের ধর্মগুরু রাম সিং কৃষকদের দুর্দশা সহ্য করতে না–পেরে এই কঠোর অন্তিম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। সুইসাইডাল নোটে লিখে যান, ‘নিজেদের অধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য যে কৃষকরা লড়াই চালাচ্ছেন, তাঁদের ব্যথা আমি অনুভব করি। সেই ব্যথা আমি ভাগ করে নিচ্ছি।কারণ সরকার তাঁদের প্রতি সুবিচার করছে না। কৃষকদের সমর্থনে কেউ কেউ তাদের পুরস্কার সরকারকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। আমি নিজেকে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
রাম সিং একা নন; ইতিহাস ঘাঁটলে দেখতে পাব, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে আত্মহনন অনেক সময়ই সুমহান স্বাভিমানের কাহিনি হয়ে উঠেছিল। হয়ে উঠেছিল বিদ্রোহের ভাষা, প্রতিবাদের আগুন।
প্রথমেই মনে পড়ে মহান দার্শনিক সক্রেটিসের নাম। সত্য বলার অপরাধে যাঁকে হেমলক বিষ খাইয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়। ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যায় রাষ্ট্র, সমাজ ও মানুষের স্বার্থে আত্মবলিদানের সংখ্যা নেহাত কম নয়।
মানুষ অনেকদিন থেকেই ভুলতে বসেছে সে আসলে প্রকৃতির সন্তান। নদী-পাহাড়-গাছ আসলে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। প্রকৃতির থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হতে, তার আর প্রকৃতির মাঝে গড়ে উঠেছে এক অবিচ্ছেদ্য দেয়াল। কেউ কেউ আবার সেই দেয়াল ভেঙে প্রকৃতিকে দু’হাতে আলিঙ্গন করে নিয়েছেন। তেমনই এক নাম জি ডি আগরওয়াল। তিনি পরিচিত ছিলেন ‘স্বামী জ্ঞানস্বরূপ সানন্দ’ নামেও। ছিলেন নামি অধ্যাপক। আইআইটি কানপুরে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদেও কাজ করেছেন অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে। এ হেন বিচিত্র কর্মকাণ্ডের মানুষটি আজীবন লড়েছেন পরিবেশের সুরক্ষার জন্য।
তারিখটা ছিল ২২ জুন, ২০১৮। গঙ্গাবক্ষে নির্মাণ বন্ধ, বালি খনন রোখা ও ‘গঙ্গা প্রটেকশন অ্যাক্ট’ চালু করার দাবিতে আমরণ অনশনে বসেন তিনি। সরকারি কর্মকর্তা থেকে মিডিয়া– কারওরই বিশেষ টনক নড়েনি।
চার মাস ধরে চলল অনশন–প্রতিবাদ। খাদ্য বলতে মাঝে–মধ্যে মধু মেশানো জল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আগরওয়াল নিজের দাবির স্বপক্ষে বেশ কয়েকটি চিঠি দেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে কোনও উত্তর না আসায় বিমর্ষ হয়ে পড়েন। ৮৭ বছর বয়সের পরিবেশবিদ অনশনের ধকল সইতে না পেরে একদিন হঠাৎ হৃদরোগে অসুস্থ হয়ে পড়েন। হৃষিকেশের এইমস হাপাতাল থেকে তাঁর আর বাড়ি ফেরা হল না।
এবার শুনি, আরটিআই কর্মী বিলাস বারডেকার–এর কথা। ২০১০ সালে আরটিআই কর্মী,সতীশ শেট্টিকে হত্যার প্রথম সাক্ষী ছিলেন তিনি। পুলিশের সুরক্ষা সত্ত্বেও তিনি আত্মহত্যা করেন। এই ঘটনায় সুইসাইড নোটে তিনি তাঁর আত্মহত্যার জন্য ৭৮ জনের নাম উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন: পুলিশ, রাজনীতিবিদদের দ্বারা তাঁর পরিবারের সদস্যরা নিরন্তর হয়রানির শিকার হয়েছেন। দু’বার তাঁর প্রাণ নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। আরটিআই কর্মীদের ব্যক্তিগত তথ্য কি আদৌ সুরক্ষিত; যে-তথ্যের অধিকারের জন্য লড়ছিলেন তাঁরা? তথাকথিত এই সামাজিক কাঠামোতে স্বচ্ছতা এবং সামঞ্জস্যের জন্য তাঁদের প্রখর দাবির কি তবে এটাই নিয়তি?
ঘটনাটি বড়সড় প্রশ্নচিহ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় আমাদের। আমরা রোজ টিভি চ্যানেলে সান্ধ্য আসরের লাভা গিলে হজম করি। রোজই আমাদের এখানে নতুন নতুন সেলিব্রিটির জন্ম হয়। দু’–চারজন এমন মানুষের মৃত্যুতে আমাদের কী–ই বা এসে যায়! মনে পড়ে, সেই অমোঘ লাইন: ‘মানুষ ছিলো নরম, কেটে, ছড়িয়ে দিলে পারতো’…
লেখা: সুশান্ত ঘোষ
পাঠ: কোরক সামন্ত
আবহ: শঙ্খ বিশ্বাস