সমীক্ষা বলছে, ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে প্রায় ২৮% নাকি মনে করেন, উন্নতমানের জীবন যাপন করতে চাইলে, যেমন করেই হোক ভারতের বাইরে বেরোতে হবে। আর এ তালিকায় সবচাইতে উপরে রয়েছে ছাত্রছাত্রী ও সদ্য চাকরিতে যোগদান করা তরুণ-তরুণীর দল। তাঁদের মতে, এ দেশে ব্যক্তিগত কিংবা সামাজিক পরিসরে সত্যিকারের উন্নয়নের তেমন কোনও সুযোগই নেই।
সবার থেকে আলাদা হতে চায় বর্তমানের তরুণ প্রজন্ম। অথচ লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তাদের সকলের মধ্যেই যেন কী এক অদ্ভুত মিল। প্রায় প্রত্যেকের চোখে হতাশার ছায়া, ক্লান্ত বিধ্বস্ত ভাব। বাবা-মায়েরা রাগ করে বলতেই পারেন যে, ‘কই, আমাদের সময়ে তো এসব সমস্যা ছিল না!’ কিন্তু তাতেও এ কথা অস্বীকার করবার জায়গা থাকে না যে, মানসিক স্বাস্থ্যের দিক থেকে সত্যিই ভালো নেই আজকের তরুণরা। এর নেপথ্যে কি রয়েছে শুধুই বদলে যাওয়া জীবনবোধ? নাকি আরও জটিল কোনও বিষয়?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই হতাশার অন্যতম কারণ নাকি বাইরের দেশের সংস্কৃতির প্রতি এ দেশের তরুণদের অদম্য আকর্ষণ! কিন্তু কেন? সাংস্কৃতিক দিক থেকে ভারতের অবস্থান যে একেবারে প্রথম দিককার সারিতে, তা বলা বাহুল্য। তা সত্ত্বেও সমীক্ষা বলছে, ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে প্রায় ২৮% নাকি মনে করেন, উন্নতমানের জীবন যাপন করতে চাইলে, যেমন করেই হোক ভারতের বাইরে বেরোতে হবে। আর এ তালিকায় সবচাইতে উপরে রয়েছে ছাত্রছাত্রী ও সদ্য চাকরিতে যোগদান করা তরুণ-তরুণীর দল। তাঁদের মতে, এ দেশে ব্যক্তিগত কিংবা সামাজিক পরিসরে সত্যিকারের উন্নয়নের তেমন কোনও সুযোগই নেই।
এ অভিযোগ অবশ্য তরুণদের নতুন নয়। অনেকেই মনে করেন, বর্তমানে সামাজিক ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা দেওয়ার মতো ব্যক্তিত্ব ভারতে বিরল। যাঁরা বা আছেন, ভারতীয় ‘ইয়ুথ’ তাঁদের সম্পর্কে ঠিকমতো ওয়াকিবহালই নয়। অন্যদিকে রাজনৈতিক নেত্রীস্থানীয় যে ব্যক্তিত্বদের সামনে রেখে অনেক সময়েই এগিয়ে যায় তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা, তাঁরা পরবর্তীকালে ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষায় মন দেন। ফলত তরুণেরা হতাশ হয় আবারও। কিন্তু তাতে কি সামগ্রিক ভাবে দেশ থেকেই মন উঠে যাবে তাদের?
এর গোড়া খুঁজতে গেলে চলে যেতে হয় অনেক দূর। সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয়তার নিরিখে সবচাইতে এগিয়ে রয়েছে তরুণরাই। সমস্ত অতি-সক্রিয়তার দায় কেবল ‘জেন-জি’-র উপরে চাপিয়ে দিলেও, এ কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে বর্তমানের তরুণ প্রজন্ম অর্থাৎ মিলেনিয়ালরাও সোশ্যাল মিডিয়ায় যথেষ্ট অ্যাক্টিভ! তবে সাধারণের দৈনন্দিন জীবনে হতাশার প্রথম আভাস যে সোশ্যাল মিডিয়ার হাত ধরেই ঢুকে পড়ে, তা হয়তো অনেকেই খেয়াল করে না। অন্য দেশের খাবার হোক বা আদবকায়দা, সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে খুব সহজে ঢুকে পড়ে বাড়ির ড্রয়িংরুমে। এমনকি আধুনিক সময়ের সিনেমা-সিরিজের চরিত্ররাও তাদের রোজকার জীবনযাপনের ধরণ দেখিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে, পাশ্চাত্য সংস্কৃতিই আধুনিকতার সঠিক পরিভাষা।
আর সেসবের প্রতি ভারতীয়দের আকর্ষণ নতুন কিছু নয়। ইংরেজরা আক্ষরিক অর্থে ভারত ছেড়ে গেলেও, তাদের ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি জায়গা করে নিয়েছিল ভারতীয় সংস্কৃতির অনেক গভীরে। পাশ্চাত্য সভ্যতাকে সামনে রেখেই ভারতীয় তরুণেরা বারবার এ দেশে প্রচলিত ব্যক্তিস্বাধীনতা কিংবা স্বচ্ছলতাকে প্রশ্ন করেছে। বিশ্বায়নের বাড়বাড়ন্তের ফলে, যে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির চর্চা এক সময়ে ‘এলিট ক্লাসের’ মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, তা বর্তমানে হয়ে উঠেছে সাধারণের চর্চার বিষয়। আর তা থেকেই জন্ম নিচ্ছে যাবতীয় হতাশা ও হীনমন্যতাবোধ।
সাম্প্রতিককালে একের পর এক সংঘর্ষ-সংঘাত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এমতাবস্থায় আগামী দিনে যে আরও ভয়াবহ কোনও যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, সে সম্ভাবনা রয়েই যায়। আর যেহেতু যেকোনও দেশের ভবিষ্যতের মূল ভিত্তিই সেখানের তরুণ সমাজ, তাই তাদের ভালো রাখার বিষয়টা সার্বিক হয়ে ওঠে বৈকি। দেশের দুর্দিনে যদি তরুণেরাই নিজের মাতৃভূমির সঙ্গে একাত্ম অনুভব করার বদলে নির্লিপ্তি বেছে নেয়, তবে তার পরিণতি কখনওই সুখকর হতে পারে না। মনোবিদরা বলছেন, এ নিয়ে আরও বেশি আলোচনা হওয়া উচিৎ। এমনকি প্রয়োজনে দেশের শীর্ষস্থানীয় আধিকারিকদের উচিৎ, তরুণদের সঙ্গে আলোচনায় বসে তাদের হতাশার কারণগুলি আলোচনা করা।
দেশ জুড়ে তরুণ প্রজন্মের এই হেরে যাওয়া মানসিকতা যেন চিৎকার করে জানান দিচ্ছে, অন্ধ হলে কখনওই প্রলয় বন্ধ থাকে না। দেশের তরুণদের যা প্রতিনিয়ত ভাবাচ্ছে, তা কি সামগ্রিকভাবে দেশের চিন্তা নয়?