প্যান্ডেমিক আমাদের জীবনকে কার্যত ইন্টারনেট–বিনে–অন্ধ করে তুলেছে। ইন্টারনেটে কম অভ্যস্ত, প্রতি মাসে নেটপ্যাক ভরানোর সামর্থ না–থাকা, স্মার্টফোন ব্যবহারে অস্বচ্ছন্দ মানুষগুলোর তাও একটা পরিসর ছিল এই ব্যবস্থার মধ্যে না পড়েও তাদের প্রাত্যহিক জীবন–যাপনের। অতিমারী এই অবস্থাকে করে তুলল গুরুতর।
প্রতিদিনের জীবন, এমনকী শিক্ষাব্যবস্থার মতো একটি সর্বজনীন বিষয় যখন ইন্টারনেট পরিষেবা ছাড়া অচল, সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আমরা ভেবে দেখেছি কি, ঠিক কত জন মানুষের পক্ষে এই পরিষেবা পাওয়া সম্ভব? কত জনের পক্ষে সম্ভব রাতারাতি এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নেওয়া? অনলাইন ব্যবস্থার এই সর্বব্যাপী স্বাভাবিকীকরণ কি চোখে আঙুল দিয়ে স্পষ্ট করে দিচ্ছে না আমাদের বৈষম্যের রাজনীতি?
বর্তমান ভারত রাষ্ট্র ভারতীয়দের মনে–মননে–আচরণে–ব্যবহারে–দৈনন্দিনে ‘এক জাতি’–র ধারণা তৈরিতে বদ্ধ পরিকর। এক দেশ-এক ধর্ম-এক ভাষা। তার এই দেশের ধারণায় রয়েছে কেবল প্রিভিলেজড শ্রেণি। বাকিদের নিয়ে কেউ ভাবিত নয়। ইন্টারনেট পরিষেবা না–পাওয়া গ্রাম, স্মার্টফোন কেনার সামর্থ না–থাকা ছেলেমেয়েগুলোর স্বর তাই এই কাঠামোয় নাকচ হয়ে যায়। ইন্টারনেটে পড়াশোনা এবং পরীক্ষা বাধ্যতামূলক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নস্যাৎ করে দেওয়া হয় এক ভারতের এক বৃহৎ অংশের অস্তিত্ব।
এমন ঘটনা সামনে এসেও চোখ এড়িয়ে যায় আমাদের। প্যান্ডেমিক পর্বে এই অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে জুঝতে গ্রামের ছাত্রের গাছে উঠে নেটওয়ার্ক আসার অপেক্ষায় বসে থাকার মতো ঘটনা আমরা দেখেছি। চোখে পড়েছে রোজগারের একমাত্র সম্বল গরু বিক্রি করে মোবাইল কেনার মতো ঘটনাও। এমনকী, পড়াশোনার জন্য রাতারাতি বাধ্যতামূলক হয়ে যাওয়া মোবাইল ফোন জোগাড় করতে অসমর্থ বালকের আত্মহত্যাও ঘটেছে এই দেশে।
তা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক কাঠামোর এই নীচুতলার মানুষগুলির অবস্থান আমাদের বারবার ভুলিয়ে দেওয়া হয়। ভুলিয়ে দেওয়া হয় ইন্টারনেট না–পৌঁছতে দেওয়া ‘কাশ্মীর’ নামক “নো ম্যান’স ল্যান্ড”–টির কথা। অনলাইন ব্যবস্থার এই স্বাভাবিকীকরণ বৈষম্যের উপর দাঁড়িয়ে থাকা দেশের সামাজিক কাঠামোটিকে আরও নগ্নভাবে উন্মুক্ত করে। এই ‘এক জাতি’ভিত্তিক রাষ্ট্রনির্মাণের প্রকল্পে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ‘অপর’ নির্মাণের রাজনীতি।
তারপর! শুনুন…
লেখা: লাবণ্য দে
পাঠ: মৌমিতা সেন
আবহ: শঙ্খ বিশ্বাস