জগন্নাথকে নিয়ে চর্চা ও তাঁর আরাধনা আঞ্চলিকতার সীমানা পেরিয়ে পৌঁছে গিয়েছে দেশবাসীর সংস্কৃতির চর্চার শিকড়ে। যে সংস্কৃতি মিলনের, সহাবস্থানের ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা-সম্ভ্রমের। জগন্নাথের যাত্রায় যখন ‘আমিত্ব’ ভুলে সকলে এক পরিচয়ে শামিল হন, তখনই যেন মুছে যেতে থাকে যাবতীয় ভেদাভেদ। আর তাই জগন্নাথের আরাধনা যেখানে হয়, সেখানে নিহিত থাকে সম্প্রীতি আর মিলনের বার্তাই।
অক্ষয় তৃতীয়ার দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে দ্বারোদ্ঘাটন হল দিঘার জগন্নাথধামের। জগন্নাথ আরাধনার ক্ষেত্রে তা এক নতুন দিগন্ত। জগন্নাথকে (Jagannath) ঘিরে বাঙালির যে আরাধনা ও চর্চা তা সাংস্কৃতিক গুরুত্ব পেয়েছে নানা কারণেই। ধর্মীয় অনুষঙ্গ নিয়েই তা ক্রমশ বাঙালির সত্তার সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে। রথযাত্রা তাই বাংলার বারো মাসের তেরো পার্বণের অন্যতম পার্বণ। জগন্নাথ (Jagannath) যেহেতু বহুত্বের প্রতীক, তাঁর আরাধনাও মিলনের মহোৎসব। মানুষে মানুষে ভেদ ভুলিয়ে গণদেবতার আরাধনা আসলে মানুষেরই সম্মিলনে পরিণত হয়। আর তাই জগন্নাথ আরাধনার ভিতর দিয়েই সম্প্রদায়গত ভেদ মুছে সম্প্রীতির দিকে এগিয়ে গিয়েছে মানুষ। তার নমুনা যেমন দেশে, তেমন এই বাংলাতেও।
ওড়িশার রেমান্দা গ্রাম যেমন এক ব্যতিক্রমী রথযাত্রার সাক্ষী থাকে। সারা দেশে রথযাত্রা হিসাবে যে দিনটিকে পালন করা হয়, এখানে রথ উৎসব পালিত হয় ঠিক তার একদিন পরে। শুধু তাই নয়, এই রথযাত্রার আরও কিছু নিয়ম দেশের অন্যান্য মন্দিরের সঙ্গে মেলে না। এখানে রথে আসীন জগন্নাথ (Jagannath) এগিয়ে চলেন, আর তাঁর চলার পথ ঝাড়ু হাতে পরিষ্কার করেন মুসলিম ভক্ত। শোনা যায়, এই গ্রামের রথ উৎসব চালু হয়েছিল অন্তত একশো বছর আগে। সেই থেকেই উৎসবে কোনও ধর্মের ভেদ নেই। প্রতি বছর হিন্দু-মুসলিমরা একইসঙ্গে অংশ নেন রথযাত্রায়। রথের রশিতেও টান দেন সকলে মিলেই। এতে কারও কোনও আপত্তি থাকে না। এমনকি মুসলিমরাও একইরকম ভক্তি নিয়ে প্রভুর রথযাত্রা উৎসবে শামিল হন। রথযাত্রার বিশেষ অঙ্গ হল জগন্নাথের (Jagannath) চলার রাস্তা ঝাঁট দেওয়া। পুরীতে সেই কাজ করনে সেখানকার মহারাজ। সোনার ঝাড়ু হাতে জগন্নাথের রথের সামনে ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে দেন তিনি। আর সেই পথ ধরেই এগিয়ে চলে রথ। রেমান্দা গ্রামে এই রাস্তা ঝাঁট দেওয়ার কাজই করেন মুসিলিম ভক্তরা। এ রেওয়াজ দীর্ঘদিনেরই। জগন্নাথকে কেন্দ্র করে যে সম্প্রীতির চর্চা, এবং তা যে লোকায়ত, এই রথযাত্রা যেন সেই ইঙ্গিতই দেয়।
আবার এই বাংলাতেই রথযাত্রায় দেখা যায় সম্প্রীতির অপূর্ব নমুনা। হাওড়ার কদমতলা অঞ্চলে আছে এমন এক রথযাত্রা, যেখানে জগন্নাথের (Jagannath) যাত্রায় মিশে থাকে মুসলিম ভক্তের অনুরাগ। হাওড়ার এই অঞ্চলে প্রভুর পরিক্রমা শুরু হয় শেখ মকবুল ইসলামের বাড়ি থেকে। পেশায় তিনি অধ্যাপক। স্রেফ তিনি একা নন, এই উৎসবে শামিল হন আরও অনেক মুসলিম ভক্ত। ছোট থেকেই তিনি জগন্নাথের ভক্ত। পাড়ায় রথ নিয়ে যে উন্মাদনা চলত তাতে শামিল হতেন। বাড়ি থেকেও তাঁকে কখনও বাধা দেওয়া হয়নি। তাই নিজেকে উৎসব থেকে আলাদা করে রাখেননি মকবুল। তাঁর বাড়ি থেকেই শুরু হয় জগন্নাথের পরিক্রমা। এখানে অবশ্য আলাদা কোনও রথ নেই। ত্রিমূর্তিকে কোলে করেই মাসির বাড়ি নিয়ে যান ভক্তরা। বাড়িটি প্রতিবেশী দিনেশ কুমার খানের। সেখানেই সপ্তাহভর পূজিত হন জগন্নাথ (Jagannath)। দেশ জুড়ে রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে হাজারও দৃশ্যের জন্ম হলেও, হাওড়ার এই অঞ্চলে যে সম্প্রীতির ছবি ধরা পড়ে, তা অবশ্যই নজিরবিহীন বলা যায়।
এই দৃষ্টান্ত জানান দেয়, জগন্নাথকে (Jagannath) নিয়ে চর্চা ও তাঁর আরাধনা আঞ্চলিকতার সীমানা পেরিয়ে পৌঁছে গিয়েছে দেশবাসীর সংস্কৃতির চর্চার শিকড়ে। যে সংস্কৃতি মিলনের, সহাবস্থানের ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা-সম্ভ্রমের। জগন্নাথের যাত্রায় যখন ‘আমিত্ব’ ভুলে সকলে এক পরিচয়ে শামিল হন, তখনই যেন মুছে যেতে থাকে যাবতীয় ভেদাভেদ। আর তাই জগন্নাথের (Jagannath) আরাধনা যেখানে হয়, সেখানে নিহিত থাকে সম্প্রীতি আর মিলনের বার্তাই।