দার্জিলিং ম্যালের ওপেন এয়ার থিয়েটারের দিকে মুখ করলে ডান পাশ দিয়ে উঠে যায় অবজার্ভেটরি হিলের চড়াই রাস্তা। হিলের একেবারে চুড়োতেই মহাকাল মন্দির।
ঢোকার মুখে লেখা: Situated atop the Observatory Hill is the ancient temple of Mahakal, with Lord Shiva as deity. অর্থাৎ, মন্দিরের বর্ণনায় শিবকে এখানকার একমাত্র উপাস্য বলা হচ্ছে। চমকটাও এখানেই। কোনও হিন্দু সাধক বা ভক্ত নয়, এর নির্মাণ বৌদ্ধ লামা দোরজে রিনজিংয়ের হাতে। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে। প্রাথমিকভাবে অবশ্য বৌদ্ধস্তূপ ছিল। নাম ছিল: ‘দোরজে লিং’। এই নাম থেকে ‘দার্জিলিং’ নামের সম্ভাব্য বুৎপত্তি। স্থানীয় ভাষায় যার অর্থ বজ্রবিদ্যুৎপ্রবণ এলাকা। শুরু শুরুর দিকে লেপচা ও ভুটিয়ারা এখানে উপাসনা করলেও পরে নেপালি গোর্খাদের আক্রমণে হিন্দু উপাসনার মূল কেন্দ্রে পরিণত হয় এটি। তবে ধর্মপাল বা বৌদ্ধ উপাস্যদের আরাধনা বন্ধ হয়নি। সমান্তরালে শুরু হয় হিন্দু বিগ্রহ উপাসনা। মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের দেবতা মহাকালের পাশাপাশিই শুরু হয়ে হিন্দু মহাকালের আরাধনা। ক্রমশ মূল উপাস্য হয়ে ওঠেন শিব।
শক্তিসঙ্গমতন্ত্রে কালীর স্বামী শিব উপস্থাপিত বিধ্বংসীরূপে। ব্রহ্মার অন্তিম বিধ্বংসী রূপ তিনি। তাঁর তিনটি চোখ বলা বাহুল্য; কিন্তু হাতের সংখ্যা চার। চারটিতে যথাক্রমে ত্রিশূল, পাত্র, তলোয়ার এবং খড়্গ। গলায় আট নরমুণ্ড দিয়ে তৈরি মালা। নিজে দাঁড়িয়ে থাকেন শ্মশানে, পাঁচটি মানুষের শবের ওপর। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী কালী– সম্মিলিতভাবে ভয়কংরূপী এই যুগল বিশ্বচরাচর ও ব্রহ্মাণ্ডকে তথা যাবতীয় অশুভ শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেন। ‘মহাকাল মন্দির’ নাম হলেও মন্দিরের গর্ভগৃহে অবশ্য শিবের এই সংহারক রূপের বিগ্রহ নেই। সেখানে সোনার জল করা তিনটি লিঙ্গ বর্তমান: যথাক্রমে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের। বাঁপাশে হিন্দু পুরোহিত বসে পুণ্যার্থীদের পুজো নেন। অদ্ভুতরকমভাবে একইসঙ্গে গর্ভগৃহের ডানপাশে উপাসিত হন বৌদ্ধ মহাকাল তথা ধর্মপাল। পুজো করেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা। অমিতাভ বুদ্ধর অবলোকিতেশ্বর রূপের বহিঃপ্রকাশ এই মহাকাল। বৌদ্ধ মহাযানতন্ত্রের এই মহাকালও হিন্দু মহাকালের মতোই সংহারের প্রতীক। একই গর্ভগৃহ থেকে একইসঙ্গে মন্দ্রিত হয় হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের উপাসনার মন্ত্র। দুই ধর্মের সম্মিলনীর সিমফোনি বাজতে থাকে উচ্চগ্রামে। চোখ বুজে প্রার্থনা সারেন বিশ্বাসীরা। সে-অর্থে যদি বিশ্বাসী না-ও হন, তবু হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্ত্রের, সংস্কৃত ও তিব্বতি ভাষার অবিরাম উচ্চারণ অতিজাগতিক কোনও অনুভূতির জগতে আপনাকে নিয়ে যেতে বাধ্য।
বাকিটা শুনে নিন…
লেখা: সোহিনী সেন
পাঠ: শ্যামশ্রী সাহা
আবহ: শুভাশিস চক্রবর্তী