ভুলে-থাকা গাজা থেকেই পৃথিবীর সামনে ছিটকে এসে পড়েছে এক ছবি, যে-ছবিকে পৃথিবী আর ভুলে যেতে পারেনি। চলতি বছরে ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফোটো’ হিসাবে সেরার তকমা জুটেছে সেই ছবিটিরই ভাগ্যে, দু-হাত হারানো বালকের যে ছবিটি তুলেছিলেন চিত্রসাংবাদিক সমর আবু এলুফ।
একটা ছবি, বিশ্বসেরা। সবাই তাকিয়ে বলছে, দুর্দান্ত! ছবিটায় কী আছে? আনন্দ, হাসি, আহ্লাদ, রং! একদম না। বরং ঠিক তার উলটোটা। ব্যথা, কান্না, হাহাকার। নতুন নয়, বিশ্বসেরা ছবির তালিকায় এমন হাহাকার স্থান পেয়েছে আগেও। তবে এবারের ছবি স্রেফ ছবি হয়েই থেকে যায়নি। সেই ব্যথা, সেই যন্ত্রণা সঙ্গে নিয়ে বেঁচে আছে ছবির সাবজেক্ট। বলা ভালো, বাঁচার কারণ খুঁজছে!
কথা বলছি, সেই ফিলিস্তিনি বালকটি সম্পর্কে। ইজরায়েলি বোমার আঘাতে উড়ে গিয়েছিল যার দুই হাত। ন-বছরের মাহমুদ আজৌর। নির্লিপ্ত চাহনি, রৌদ্রস্নাত চোখ-মুখ-গাল। শুধু শরীরটাই আছে, দুটো হাত নেই। ছবিটি তুলেছিলেন চিত্রসাংবাদিক সমর আবু এলুফ। চলতি বছরে ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফোটো’ হিসাবে সেরার তকমা জুটেছে সেই ছবিটিরই ভাগ্যে। আর সেখানেই কতশত প্রশ্ন ভিড় করে এসেছে তার ইয়ত্তা নেই।
যুদ্ধের দেশে এক শিশুর এমন অবস্থা হবে, একথা নতুন করে কী আর বলার। প্যালেস্তাইনের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এ তো রোজের খবর। তবে নিছক খবর-ই। কেন-না গোটা পৃথিবীই এতদিনে সে খবরের পাতা উলটে অন্য খবরে পৌঁছে যাওয়ার অভ্যাস করে ফেলেছে। গাজার শিশুরাও এতদিনে জেনেই গিয়েছে, কেবল গাজায় জন্মেছে বলেই তাদের জন্মের সঙ্গে লগ্ন হয়ে আছে বরাবরের অভিশাপ। সে-জন্ম যে কোনও মুহূর্তে ‘নেই’ হয়ে যেতে পারে কোনও ইজরায়েলি হামলায়। এমনকি সেই না-থাকার খবরও হারিয়ে যেতেই পারে ছিন্নভিন্ন পরিচয়হীন দেহ থেকে। তবে এমন বিস্মৃতির বয়ানের মধ্যে থেকেই আচমকা পালটে গিয়েছে ন-বছরের মাহমুদ আজৌরের গল্পটা। ভুলে-থাকা গাজা থেকেই পৃথিবীর সামনে ছিটকে এসে পড়েছে তার ছবি, যে-ছবিকে পৃথিবী আর ভুলে যেতে পারেনি। ছবি দেখে অনেকের চোখের কোনে জল এসেছে, বেশ কিছু আলোচনাও হয়েছে অবশ্যই, কিন্তু সেসবের মেয়াদ কতদিন?
প্রশ্নটা তোলা থাক। বরং ফিরে দেখা যাক, সেই আজৌরের দিকে। যার ছবি জগতসেরা, সে কি বিষয়টা সাফল্যের মতো দেখছে? বোধহয় না। কারণ তার কাছে বেঁচে থাকাটাই জিজ্ঞাস্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতশত আলোচনার ভিড়ে তার একটাই প্রশ্ন, এ জীবন লইয়া করব কী? নিঃসন্দেহে বলা যায়, এ প্রশ্ন যে কোনও সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের বুকে তীরের ফলার বিঁধতে পারে। গলার কাছে কিছু একটা দলা পাকিয়ে যেতেই পারে। উত্তর দিতে চাইলেও কিছুই বলতে পারবেন না কেউ। কারণ উত্তর নেই। যে যুদ্ধ নিয়ে ভাবার মতো সময় এতদিন কেউ খুঁজে পাননি, সেই যুদ্ধে এক শিশুর হাত উড়ে গিয়েছে, আর সে বেঁচে থেকে কী করব প্রশ্ন করছে, তাতে কার কি বা বলার থাকতে পারে।
শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্ম হয়েছে, এমন শিশুর সংখ্যা কম নয়। সমাজ এদের বরাবর অন্য চোখে দেখে। অদ্ভুত এক সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে এদের বড় হতে হয়। সুযোগ পেলে নিজেদের প্রতিষ্টিত করতে পারে কেউ কেউ। না হলে উপার্জের অন্য পথ বেছে নিতে হয়। ভিক্ষাবৃত্তি এক্ষেত্রে সবচেয়ে চেনা উপায়। কিন্তু সমাজ যাকে প্রতিবন্ধী করে দিল, সমাজ যাকে বাধ্য করল জীবন বদলাতে, সে কী করবে? আজৌরের প্রশ্নের উত্তরে এমনই কতশত প্রশ্ন উঠে আসে। বর্তমানে শারীরিক ভাবে সে সুস্থ। তবে খাওয়া, স্নান করা, সহ যাবতীয় দৈনন্দির কাজে তাকে অন্যের উপর নির্ভর করতে হয়। এই তো সেদিন অবধি ওই দুট হাত নিয়ে নিজের মতো খেলে বেড়াত আজৌর, এখন কীভাবে খেলবে সে? আবারও একটা এড়িয়ে যাওয়ার মতো প্রশ্ন। নিজের জীবনের সে ভয়ংকর দিন কখনও ভুলতে পারবে না সে। সারাজীবন সেই অভিজ্ঞতা বয়ে বেড়াত হবে। তবে সেসবের ভিড়েও একটাই প্রশ্ন ঘুরেফিরে করে চলেছে আজৌর, বেঁচে থেকে কী হবে? এমন নয় এত কষ্ট সহ্য করে বেঁচে থাকাটা মানতে পারছে না সে, বরং চারদিক শূণ্য হয়ে যাওয়াটা তাকে বেশি ভাবাচ্ছে। চেনা এলাকা কীভাবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে সেই ছবি সে দেখেছে। না চাইলেও মানতে হয়েছে সেই সত্যি। কিন্তু ধ্বংসলীলা তো এখনও থামেনি! আর কবে, আরও কতকিছু শেষ হলে শান্ত হবে চারদিক? এই প্রশ্নের উত্তরও খুঁজে বেড়াচ্ছে আজৌর। হয়তো তার মতো আরও অনেকে খুঁজছে। সেই ভিড়ে এমনও কেউ কেউ হয়তো রয়েছে, যাঁদের পৃথিবীতেই আর জায়গা হয়নি!