সাধারণ অর্থে যাঁদের আমরা ‘সেলিব্রিটি’ বলে থাকি, তাঁদের কি যে কোনও ঘটনায় নির্দিষ্ট অবস্থান নিতেই হবে? আর যদি তিনি অবস্থান নেন, তা কি সোচ্চারে ঘোষণা করতেই হবে? যদি কেউ তা না-করেন, সেই স্বাধীনতাও কি তাঁর থাকা উচিত? এই আলোচনার পরিসর খুলে দিচ্ছে সাম্প্রতিক নানা ঘটনাবলি।
প্রিয় অভিনেতা কিংবা গায়ক। যাঁর বা যাঁদের রচিত শিল্প-সংগীত অনেকেরই আজীবনের সঙ্গী। সেই তিনি, বা তাঁরা কেন নির্দিষ্ট কোনও ঘটনার ক্ষেত্রে একেবারে প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে যান!যে মানুষ শিল্প সৃষ্টি করেন, সংগীত রচনা করেন, তিনি কি তাহলে তেমন সংবেদনশীল নন! নাকি শিল্পীর ‘সামাজিক দায়’ বলে কিছু থাকতে নেই?
প্রশ্নের নানা মুখ।
এমন নয় যে, সমাজে কোনও বিশ্রী ঘটনা ঘটে গেলে সব শিল্পীই নিশ্চুপ থাকেন। এমন নয় যে, দেশ-বিদেশের কোনও রাজনৈতিক ঘটনা, যা কিনা জনমানসে বড় অভিঘাতের জন্ম দিচ্ছে, তা শিল্পীমহলকে আলোড়িত করছে না। কেউ কেউ নিশ্চিতই কথা বলছেন। তাঁদের প্রতিবাদী স্বর ভাস্বর হয়ে উঠছে। আবার একই সঙ্গে পছন্দের কোনও কোনও শিল্পীর নীরবতা মানুষকে ব্যথিত করছে। অভিযোগের তির তাই ঘুরে যাচ্ছে তাঁদের দিকে। পালটা বক্তব্য পেশ করে তাঁদের জানাতে হচ্ছে, কেন তাঁরা কোনও ঘটনার প্রেক্ষিতে কথা বলেছিলেন বা বলেননি।
তর্ক বা আলোচনার অভিমুখ তাই ঘুরে যাচ্ছে অন্য এক প্রশ্নে, তা হল, সাধারণ অর্থে যাঁদের আমরা ‘সেলিব্রিটি’ বলে থাকি, তাঁদের কি যে কোনও ঘটনায় নির্দিষ্ট অবস্থান নিতেই হবে? আর যদি তিনি অবস্থান নেন, তা কি সোচ্চারে ঘোষণা করতেই হবে?
আরও শুনুন: ছোটগল্পের ঋত্বিকই ক্রমে সিনেমার ‘নীলকণ্ঠ’
শিল্পীর সামাজিক দায় প্রসঙ্গটির প্রসার ও বিস্তার অন্যরকম। তা বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে। তবে, সাম্প্রতিক এই প্রশ্ন উত্থাপনের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া। যাঁরা জনপ্রিয়, যাঁদের কাজ বহু মানুষকে মুগ্ধ করে, তাঁদের প্রতি মানুষের পৃথক সম্ভ্রম বরাদ্দ থাকে, এ কথা সত্যি। সুতরাং অনুগামী হিসাবে একজন ধরেই নেন যে, যে-মানুষটি তাঁর প্রিয়, তিনি একজন সর্বাঙ্গসুন্দর মানুষ। সব বিষয়ে নিখুঁত। অনুগামীর মতের সঙ্গে, পথের সঙ্গে সেলিব্রিটির মত-পথের পার্থক্য থাকতেই পারে না।
সন্দেহ নেই যে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে সেলিব্রিটিদের যে-সম্পর্ক, তার খোলনলচে বদলে গিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার সৌজন্য। যাঁরা দূরের তারা, তাঁরা আজও দূরেরই বটে। তবে, সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁদের নিয়ত অনুসরণ একরকমের ব্যক্তিগত সংযোগের ধারণা এনে দিয়েছে। মনে হচ্ছে না যে, তিনি আর ঠিক ততটা দূরে আছেন। ফলত, একজন সেলেবের সঙ্গে যে অপরিচয়ের দূরত্ব থেকেই যায়, তা আমরা আর গুরুত্বের সঙ্গে ধর্তব্যের মধ্যে ধরছি না।
এর দরুন, একরকম অধিকারবোধের প্রশ্ন এসে যায়। অর্থাৎ, অনুগামী হিসাবে আমি যে তারকার তারিফ করি, তাঁর জন্য বন্ধুমহলে ঝগড়া করি, তাঁকেও আমার মতকে সমর্থন করতেই হবে। আমার দৃষ্টির সঙ্গে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির কোনও ফারাক বা বিচ্যুতি আমরা মেনে নিতে তৈরি নই। সোশ্যাল মিডিয়া যে তাৎক্ষণিক তৃপ্তি বা ইনস্ট্যান্ট গ্র্যাটিফিকেশনের অভ্যাস আমাদের মধ্যে চারিয়ে দিয়েছে, তার দৌলতেই আমাদের প্রত্যাশা যে- জনপ্রিয় ব্যক্তিরা সব বিষয়েই কথা বলুন। প্রতিবাদে সোচ্চার হোন।
আরও শুনুন: ট্রাম-ম্যানগ্রোভে ফোঁটা যেন বাঙালির ব্রতকথারই আধুনিক সংস্করণ
এ-চাহিদা একেবারে ভুল, তা বলা যায় না। তবে, এর মধ্যে অনেকখানি ভ্রান্তিও আছে বইকি! সেলিব্রিটিরা যে একজন পৃথক মানুষ, তাঁর চর্চা-চর্যা যে আলাদা, এই সামান্য কথাটি ভুলে যাওয়াই ভ্রান্তি। একজন শিল্পীর সামাজিক দায় নিশ্চয়ই থাকবে। তিনি তাঁর শিল্পমাধ্যমেই তা প্রকাশ করবেন। অতীতের বহু শিল্পীর দিকেই আজ যখন আমরা ফিরে তাকাই, দেখব, সারা জীবনের কর্মকাণ্ডে তিনি কতখানি রাজনৈতিক বা সেরিব্রাল। দেখা যাবে, সমাজের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে তিনি কতটা ভাবিত ছিলেন এবং তাঁর কাজে সে বিষয়ে তিনি কতখানি সোচ্চার। কিন্তু একই সঙ্গে আমরা কি মিলিয়ে দেখি, তাঁর জীবদ্দশায় প্রতিটি দুর্ঘটনা বা রাজনৈতিক ঘটনায় তিনি কী বক্তব্য রেখেছিলেন? একজন শিল্পীর রাজনৈতিক সচেতনতা বুঝতে তা সর্বদা দরকার হয় না। যদি বক্তব্য বা বিবৃতি পাওয়া যায়, তবে নিশিচতই সেই শিল্পীকে অনুধাবনের ক্ষেত্রে তা সহায়ক। তবে তাই-ই একমাত্র সূচক হতে পারে না।
তবে,সমসাময়িকের ক্ষেত্রে এই যুক্তি খাটে না। বা, আমরা মনে রাখতে চাই না। একজন শিল্পীর শৈল্পিক উৎকর্ষের সঙ্গেই আমরা মিলিয়ে নিতে চাই তাঁর সামাজিক ভুবনকে। এর অনেকখানি নির্মাণ সোশ্যাল মিডিয়ার হাত ধরেই। আর তাই কোনও ঘটনায় প্রিয় সেলেব্রিটি সেই মাধ্যমে নীরব থাকলেই তাঁর অনুগামীরা তাঁকে বা তাঁদেরকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন।
এই যে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেওয়া, অনেকেই মনে করেন তাও একরকমের জবরদস্তি। এর মানে এই নয় যে, যাঁরা তারকা তাঁরা কোনও বিষয়ে কথা বলবেন না। প্রতিবাদ করবেন না। তবে, সেই প্রতিবাদের রকমফের থাকতেই পারে। সময়ের চরিত্র এখানে বড় ভূমিকা নেয়। এক একটি সময়ের ভিতর যে আন্দোলন, তার প্রতিফলন যেমন শিল্পীর জীবনে থাকে, বক্তব্যে থাকে তেমন থাকে তাঁর শিল্পেও। সময়ের পরত পালটে গেলে শিল্পীর বক্তব্য প্রকাশের ধরনও বদলে যেতে পারে। সময়ের সঙ্গেই সাযুজ্য রেখে প্রতিবাদ, বিবৃতি, বক্তব্যের নতুন রূপ দেখা যায়। এমনকী, বর্তমানেও, রাষ্ট্রের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে কেউ খোলাখুলি সোচ্চার হতেই পারেন। কথা বলতে পারেন গণমাধ্যমে। তবে, যদি কেউ তা না করেন, তাহলে তাঁর সেই স্বাধীনতাও থাকা উচিত। কেননা, একজন মানুষ- তিনি শিল্পে-সংগীতে পারঙ্গম বলেই তিনি সব বিষয়ে কথা বলতে পারেন এমন ধারণা সর্বৈব সত্যি নয়। বা জনপ্রিয়তাও তাঁদেরকে সব বিষয়ে কথা বলার অধিকারী করে তোলে, তা বলা যায় না। ফলত ‘অমুক সেলেব কেন কথা বলছেন না?’ এ-প্রশ্ন যেমন জোরাজুরি, তেমনই এই বিষয়ে কথা বললে অন্য বিষয়ে নীরব কেন, এই হোয়াটঅ্যাবাউটারিও এক ধরনের জোর খাটানোই।
আরও শুনুন: যৌন হেনস্তা, তবু মুখ খুলতে ভয় মেয়েদের… ‘দহন’ চিনিয়েছিলেন ঋতুপর্ণ
আদতে তা আর এক প্রবণতার জন্ম দিচ্ছে যাকে বলা হয় ফেক অ্যাকটিভিজম(faketivism)। অর্থাৎ সোশ্যাল মিডিয়ায় যাতে প্রশ্নবাণ বা ট্রোল এড়ানো যায়, সে কারণে হয়তো কেউ কোনও ঘটনায় বিবৃতি দিয়ে দিলেন। তার মানেই যে তিনি বিষয়টিতে সহমত বা তাঁর রাজনৈতিক অনুশীলনের মধ্যেই সেই চিন্তা-চেতনা আছে তা প্রমাণিত হয় না। সাধারণত তা মিলিয়েও দেখা হয় না। আবার অপরদিকে কেউ নীরব মানেই তিনি সমাজ-দেশ-পরিবেশ-প্রতিবেশ নিয়ে উদাসীন তা-ও এক কথায় বলা যায় না। একজন অভিনেতা যেমন সিনেমার চরিত্র নন; তেমনই একজন মোটিভেশনাল স্পিকার স্বাভাবিক জীবন যাপনের কথা বলছেন মানেই তিনি কোনও বিলাসবহুল জিনিস ব্যবহার করবেন না, তাও নয়। অর্থাৎ নেটদুনিয়ার জীবন আর বাস্তব জীবনের যে পার্থক্য জরুরি, সঙ্গত এবং আছে, তা আমদের মেনে নেওয়াই উচিত।
সেলিব্রিটিরা সময় ও সমাজের দায় পালন করছেন কি-না, সে প্রশ্ন বাইরের মানুষের নয়; তাঁদের নিজেদের জন্যই জরুরি। সুতরাং তাঁদের সরবতা কিংবা নীরবতার প্রসঙ্গ এবং স্বাধীনতাও তাঁদের হাতেই থাকা উচিত। নেটদুনিয়ার সম্ভবত এই সীমারেখাটিকে অগ্রাহ্য করে চলেছে বলেই যাবতীয় ভ্রান্তিবিলাস।