শুনতে যান্ত্রিক লাগলেও আসলে এ ধরণের যুদ্ধ মানবিকতার কথাই বলে! যন্ত্রের বিরুদ্ধে যন্ত্রই যদি যুদ্ধে নামে, তাহলে প্রাণহানির আশঙ্কাই থাকে না! নয়তো প্রতি বছর পৃথিবীর নানান প্রান্তে কেবল দেশের হয়ে যুদ্ধে নেমেই তো প্রাণ হারান কত যুবক-তরুণ। তাই তো সন্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে চায়, এমন খবরেই কেঁদে আকুল হয় কত মা! যুদ্ধ যদি দুই দেশের এআই-পাওয়ারড্ বট-রাই লড়তে নামে, তাহলে যন্ত্রই বিকল হবে বড়জোর, মানুষ বেঁচে যাবে।
হলিউডি সিনেমা আমাদের বুঝিয়েছে, প্রযুক্তিগত ভাবে উন্নত ভবিষ্যতের যুদ্ধ মানেই রণক্ষেত্র দাপিয়ে বেড়াবে অতিকায় রোবট। ছুটন্ত গাড়ি কিংবা ট্যাঙ্কার মুহূর্তে রূপ বদলে কোনও ক্ষেপণাস্ত্রের আকার ধারণ করবে। আকাশে উড়বে হাইপার-অ্যাক্টিভ বট, যা থেকে বেরনো লেজার ধ্বংস করে দেবে শত্রুপক্ষকে। কিন্তু বাস্তবে দেখতে গেলে, এমনটা তো আর হঠাৎ একদিন থেকে শুরু হয়ে যাবে না। বরং তা হবে সন্তর্পণে, গোপনে, সাধারণ নাগরিকদের ধারণার একেবারে বিপরীতে গিয়ে। মানুষে-মানুষে সরাসরি যুদ্ধের যে ধারা চলে এসেছে এতকাল ধরে, তার মধ্যেই এক সময় থেকে ধীরে ধীরে ভাগ বসাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। তারপর হয়তো সংখ্যায় বাড়বে। একসময়ে মানুষের চাইতেও আগে যুদ্ধক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে কোনও ‘অ্যাটাক বট’। শুনতে গল্পকথা মনে হলেও, এআই কিন্তু সত্যি সত্যিই পা রেখেছে বাস্তবের যুদ্ধক্ষেত্রে। অন্তত অপারেশন সিঁদুরে ‘হ্যারোপ’, ‘হেরন’ প্রভৃতি এআই-পাওয়ারড্ ড্রোনের ব্যবহার সেদিকেই ইঙ্গিত করছে।
সপ্তাহখানেক আগের কথা, ভারতীয় প্রতিরোধ ব্যবস্থার পরিচালনায় অপারেশন সিঁদুর মুহূর্তে গুঁড়িয়ে দিল বেশ কয়েকটি পাক জঙ্গি ঘাঁটি। পাক সন্ত্রাসীদের হামলায় নৈসর্গিক পহেলগাঁওতে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ২৬ জন ভারতীয়। অপারেশন সিঁদুর আদতে তারই প্রত্যাঘ্যাত। আর এ লড়াইয়ের সামনে রইল উচ্চ প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনা সম্বলিত ‘হ্যারোপ’ ও ‘হেরন’-এর মতো বেশ কয়েকটি ড্রোন। নিজস্ব বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে এই ড্রোনগুলি নির্দিষ্ট এলাকা জুড়ে টহল দিতে পারে, যুদ্ধ কৌশল নির্ধারণ করতে পারে এবং সবশেষে লক্ষ্যবস্তু বেছে নিয়ে হামলাও হানতে পারে। আর এরই সঙ্গে পাকাপাকিভাবে ভারত অংশ হয়ে উঠল এমন এক আগামীর, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অংশগ্রহণ ছাড়া যুদ্ধও অসম্পূর্ণ!
সত্যি বলতে, ভারতের রণাঙ্গনে এআই-এর এহেন ব্যবহার নতুন হলেও পৃথিবী জুড়ে ঘটে চলা বিগত বেশ কয়েকটি যুদ্ধেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। যেমন রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে হওয়া যুদ্ধটির কথাই বলা যাক। রাশিয়ার অত্যন্ত ক্ষমতাশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ইউক্রেনের একমাত্র সহায় ছিল এআই-চালিত ড্রোন। অ্যাল্গোরিদমের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এই ড্রোনগুলো। এর সাহায্যে ইচ্ছেমতো শত্রুপক্ষের হাতিয়ার বিকলও যেমন করতে পারবে, তেমনই আক্রমণও করতে পারবে প্রয়োজনে। একইভাবে গাজায় আক্রমণের ক্ষেত্রে ইজরায়েল ভরসা রেখেছিল ‘দ্য গস্পেল’ ও ‘ল্যাভেন্ডার’ নামের উন্নত অ্যাল্গোরিদমের উপর।
যদিও ড্রোন-যুদ্ধের পুরোধা যদি বলতে হয়, তাহলে নাম আসে টার্কির। ২০২০ সালে লিবিয়ার উপর আক্রমণের ক্ষেত্রে ‘কারগু-২’ নামে যে ড্রোনের ব্যবহার করেছিল তারা, সে ড্রোনটিকে চালনা করতে মানুষের হতক্ষেপের প্রয়োজনই পড়ে না! তবে এ তথ্য কেবল অবাক করে না, গভীরে ভাবলে রীতিমত অস্বস্তি পেতে হয়। কেন? কারণ গবেষকরা জানাচ্ছেন, আগামী দিনে ড্রোন ছাড়াও অন্যান্য নানান ধরণের বট-এর ব্যবহার হতে পারে যুদ্ধক্ষেত্রে। প্রাথমিকভাবে সেগুলো পরিচালনার জন্য মানুষকে প্রয়োজন হলেও, একসময়ে সেসব যন্ত্রের ভিতরকার কলকবজা এতটাই উন্নত করে তোলা সম্ভব হবে, যে, সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে কোনও মানুষকে সরকারই হবে না! কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে সেইসব যন্ত্রেরা নিজেরাই যুদ্ধ সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেবে। কেউ হয়তো শত্রু শিবির বেছে নিয়ে অন্যদের জানান দেবে। কেউ আবার ঢালের মতো একা হাতেই রোধ করবে সমস্ত আক্রমণ। অন্য কোনও বট হয়তো নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে যাবে ক্ষতিগ্রস্ত একালার মানুষদের। কোনও বট আবার ‘স্ট্র্যাটেজি’ তৈরি করে পরিচালনা করবে বাকিদের।
কিছু গবেষক মনে করছেন, শুনতে যান্ত্রিক লাগলেও আসলে এ ধরণের যুদ্ধ মানবিকতার কথাই বলে! যন্ত্রের বিরুদ্ধে যন্ত্রই যদি যুদ্ধে নামে, তাহলে প্রাণহানির আশঙ্কাই থাকে না! নয়তো প্রতি বছর পৃথিবীর নানান প্রান্তে কেবল দেশের হয়ে যুদ্ধে নেমেই তো প্রাণ হারান কত যুবক-তরুণ। আর এ ক্ষতি সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকে না। সেনায় থাকা প্রত্যেক ব্যক্তির পরিবারকেও অতল সাগরে ফেলে দেয় মুহূর্তে। তাই তো সন্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে চায়, এমন খবরেই কেঁদে আকুল হয় কত মা! যুদ্ধ যদি দুই দেশেরই এআই-পাওয়ারড্ বট-রাই লড়তে নামে, তাহলে যন্ত্রই বিকল হবে বড়জোর, মানুষ বেঁচে যাবে।
তবে শুধুই কি যুদ্ধ লড়ে থেমে যাবে সেই রোবটরা? নাকি অন্যদলের বট-দের উপর বিজয় ঘোষণার পাশাপাশি দখল নিতে চাইবে মানুষের পৃথিবীর উপরেও? গবেষকরা বলছেন, এমন সম্ভাবনা নাকি উড়িয়ে দেওয়া যায় না! তবে সত্যিই যে কী হবে, সে উত্তর কেবল সময়ই দিতে পারবে।