একপ্রকার যেন ভয় দেখিয়েই বুঝিয়ে দেওয়া হয় সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া মানুষটিকে যে, বড়দের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের পাল্টা প্রশ্ন করতে নেই কখনোই। তার জিজ্ঞাসু সত্ত্বাটিকেই দমিয়ে দেওয়া হয়। ছেলে বা মেয়েটি ভাবতে শুরু করে, সে যে বাবা-মায়ের দেখিয়ে দেওয়া গতে বাঁধা জীবন বেছে নিতে চাইছে না, এই যে তার ইচ্ছে হচ্ছে একেবারে স্রোতের বিপরীতে গিয়ে অন্য কিছু করার, এ আদতে অন্যায়! স্বপ্ন দেখাই যেন অপরাধের সমতুল্য।
সমাজ নয়, বরং নিজের বাবা-মায়ের (Parenting) চোখে ছোট হওয়াকেই সবচাইতে বেশি ভয় পায় ভারতীয়রা। বিশ্বস্তরে আয়োজিত এক সমীক্ষা জানাচ্ছে, তরুণ প্রজন্মের প্রায় ৮৮ শতাংশই মানেন এই কথা। বাবা-মায়ের (Parenting) সামনে মুখ রাখতে, তাঁরা প্রয়োজনে মিথ্যে কথা বলেন। এমনকি হঠকারী সিদ্ধান্তও নিয়ে বসেন সময়বিশেষে। অথচ বাবা-মায়ের (Parenting) সঙ্গে ইশ্বরের তুলনাও তো ছোট থেকেই গেঁথে যায় মানুষের মনে। তাহলে এমন কোনও ঈশ্বরতুল্য ব্যক্তিকে ঠকানোর প্রবণতা কেন তৈরি হয় তাদের মধ্যে? এর প্রভাব কি সমাজকে আরও গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে না? সে আলোচনা করতে বসলে উঠে আসে নানান প্রসঙ্গ।
খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, ভারতীয় সমাজে কোথাও গিয়ে যেন তালগোল পাকিয়ে যায় সম্মান আর আনুগত্যের মূল ধারণা দুটি। বাবা-মা (Parenting) হোক বা অন্য কোনও গুরুজন, সম্মান করা সত্ত্বেও যে দ্বিমত প্রকাশ করা যেতে পারে, এমনটা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারে না মানুষ। ফলত, সন্তান যদি জীবনের কোনও পর্যায়ে গিয়ে বাবা-মায়ের কথার অবাধ্য হয়, তাহলে কেবল বাড়ির লোক নয়, তার আশেপাশে থাকা সকলে মিলেই যেন কাঠগড়ায় দাঁড় করায় তাকে। বেশিরভাগ বাবা-মা (Parenting) যে সন্তানের ভালোই চাইবেন, তা বলা বাহুল্য। কিন্তু সন্তানটিও যে একজন ব্যক্তিমানুষ, তারও যে কোনও ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে, এমন সম্ভাবনা যেন উড়িয়েই দেওয়া হয় একপ্রকার। উপরন্তু তার উপর ‘খারাপ মানুষ’ হওয়ার তকমা সেঁটে দেওয়া হয়। ছোটদের প্রশংসা করতে প্রায়শই বলা হয়, “কী ভালো ছেলে! বড়দের সব কথা শোনে!” অর্থাৎ, ভালো সন্তানের সংজ্ঞার মধ্যেই বাধ্যতামূলক হয়ে যায় আনুগত্যের প্রসঙ্গটি।
একপ্রকার যেন ভয় দেখিয়েই বুঝিয়ে দেওয়া হয় সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া মানুষটিকে যে, বড়দের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের পাল্টা প্রশ্ন করতে নেই কখনোই। তার জিজ্ঞাসু সত্ত্বাটিকেই দমিয়ে দেওয়া হয়। ছেলে বা মেয়েটি ভাবতে শুরু করে, সে যে বাবা-মায়ের (Parenting) দেখিয়ে দেওয়া গতে বাঁধা জীবন বেছে নিতে চাইছে না, এই যে তার ইচ্ছে হচ্ছে একেবারে স্রোতের বিপরীতে গিয়ে অন্য কিছু করার, এ আদতে অন্যায়! স্বপ্ন দেখাই যেন অপরাধের সমতুল্য। ফলে এই মানুষদের একাংশ, বড়দের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তই মাথায় তুলে নিচ্ছে। গভীর মানসিক অবসাদ নিয়ে খানিক যন্ত্রের মতো জীবনযাপন করছে তারা।
অন্য একাংশ বিদ্রোহী হয়ে উঠছে। তাদের মনে হতে থাকছে, পছন্দের জীবন বাঁচতে চাইলে বুঝি বাবা-মায়ের (Parenting) বিরোধিতা করতেই হবে। এর জেরে বাড়ছে নানাধরণের অসামাজিক কাজ। অভিভাবকের সঙ্গে সন্তানের মানসিক দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। এমনটা যে কেবল বাড়ির ভিতরের পরিবেশকে প্রভাবিত করছে তা-ই নয়, এর প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক সামাজিক পরিকাঠামোর উপরেও।
এর কি তবে কোনও প্রতিকার নেই? আছে! কিন্তু তার জন্য সবার প্রথমে কমনীয় হতে হবে বাবা-মায়েদেরকেই (Parenting)। মনোবিদরা বলছেন, আধুনিক বাবা-মায়েদের উচিৎ সন্তানের বন্ধু হয়ে ওঠা। বকাবকি করে মত চাপিয়ে দেওয়ার বদলে, পাশে বসে গল্পচ্ছলে ভালোমন্দ বোঝান। নতুন মত গ্রহণের জন্য নিজেদের মনকে উদারও করতে হবে বাবা-মায়েদের। তাঁদের বুঝতে হবে যে, কেবল বয়সে ছোট বলেই উড়িয়ে দেওয়া চলে না তাঁর সন্তানের মতামত। বরং নতুন প্রজন্মের অংশ হওয়ার কারণে, কিছুক্ষেত্রে হয়তো সত্যিই বড়দের চাইতে তাদের মতই বেশি গ্রহণযোগ্যতা রাখে।
অন্ধ আনুগত্য প্রকাশ না করেও বাবা-মাকে (Parenting) সম্মান করতে পারে সন্তান, ভালোবাসতে পারে। বদলে বাবা-মাও সরাসরি বিরোধিতা না করে, সন্তানের যুক্তির ভুল-ঠিক আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে আসতে পারেন। মনোবিদেরা একবাক্যে বলছেন, দু’তরফ থেকেই এগিয়ে আসতে হবে কয়েক কদম। অভিভাবক ও সন্তানের সম্পর্কের যে চিরাচরিত সমীকরণ, তাকে নতুন আঙ্গিক দেওয়ার দায়িত্ব তুলে নিতে হবে দুই পক্ষকেই।