বৃষ্টির দিনে ইলিশ-খিচুড়ি যেন উত্তম-সুচিত্রার জুটি! তবে অনেকের কাছেই এর চেয়েও উত্তম হতে পারে অন্য কিছু। মদ্যপানের কথাই বলছি। যাদের অভ্যাস আছে তারাই জানে বাদলমুখর দিনে ‘চিয়ার্স’ বলার সুখ! কিন্তু মদ খাওয়ার আগে কেন এই শব্দ বলতে হয়? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
সকাল থেকে বৃষ্টি। রেডি হয়েও অফিস যাওয়া হয়নি। অগত্যা বাড়িতেই সারাদিন। বই পড়ে, সিনেমা দেখে কাটিয়ে দেওয়া যাবে, এমনটা ভাবার আগেই কলিংবেলের শব্দ। দরজার ওপারের গলাটা বড্ড চেনা। এমন বৃষ্টির দিনে এই গলা শুনতে পাওয়াটাও স্বাভাবিক। একইসঙ্গে তারপরের ঘটনাগুলোও।
পরিস্থিতিটা কাল্পনিক হলেও অনেকেই এর সঙ্গে নিজেদের মিল খুঁজে পাবেন। দরজার ওপারে থাকা ব্যক্তিটি অত্যন্ত কাছের বন্ধু। যিনি বৃষ্টির দিনে হাজির হয়েছেন, এবং সঙ্গে এনেছেন এক বোতল রঙিন জল। মদ্যপান যে স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর একথা এঁরা ভালমতো জানেন। তবে এক-আধদিন খেলে কিছু হবে না, এই ভাবনাও বেশ দৃঢ়। বাদলমুখর দিনে চিয়ার্স বলার আনন্দটাই মুখ্য। স্বাভাবিক এই দৃশ্য নিয়ে আলাদা কিছু বলার নেই। কিন্তু মদ খাওয়ার আগে যে চিয়ার্স (History of Cheers) বলার নিয়ম সেটা নিয়ে কথা হতেই পারে।
মদ্যপানের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। শোনা যায়, দেবতারাও নাকি নিয়মিত সুরাপান করেন। প্রাচীন পুঁথিতে সেই উল্লেখ রয়েছে। মহাভারত, রামায়ণের মতো কাহিনিতেও বারেবারে ফিরে এসেছে সুরাপানের প্রসঙ্গ। সেখানে যদিও চিয়ার্স শব্দের উল্লেখ নেই। মনে করা হয় প্রথমবার এই শব্দ ব্যবহার হয়েছিল ১৮ শতকের শেষদিকে। ফরাসি শব্দ চিয়ার থেকে চিয়ার্স শব্দটি এসেছে বলে দাবি করেন ঐতিহাসিকরা। যদিও সে নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে চিয়ার্সের শব্দার্থ নিয়ে কোনও আলাদা মত নেই। আনন্দ আর বন্ধুত্বের উদযাপনকেই বোঝানো হয় এই শব্দের মধ্যে দিয়ে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না, মদ্যপান ব্যাপারটা মূলত বন্ধুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তাই চিয়ার্স বলতে বন্ধুত্বের আনন্দযাপনকে বোঝালে সমস্যার কিছু নেই। কিন্তু স্রেফ মুখে বললেই হল না, নিজের গ্লাসের সঙ্গে বন্ধুর মদের গ্লাস হালকা ঠুকে ‘চিয়ার্স’ করতে হয়। এই নিয়ম পালনের কারণ নিয়েই রয়েছে নানা ব্যাখ্যা।
একসময় নিরাপত্তার স্বার্থে এমনটা করা হত। রাজা মদ খাওয়ার আগে অন্যদের গ্লাসের সঙ্গে নিজের গ্লাস আলতো করে ঠোকা লাগিয়ে নিতেন। যাতে তাঁর গ্লাসে থাকা মদ অন্যের গ্লাসে চলকে পড়ে। ব্যাপারটা খুব সহজভাবে হাসির আড়ালে করা হত, যাতে অপরজন মনে করেন বিষয়টা সৌজন্য বিনিময়। কিন্তু আসলে রাজা যাচাই করে নিতেন তাঁর গ্লাসের মদে কেউ বিষ মিশিয়েছে কিনা। কেউ যদি চিয়ার্স করতে অস্বীকার করত তাহলেই রাজা বুঝে যেতেন গোলমাল আছে। তক্ষনি সেই গ্লাস বদলের হুকুম দিতেন। একটা সময়ের পর নিরাপত্তার কারণকে সামনে রেখে চিয়ার্স করাটা একপ্রকার নিয়মের মতো হয়ে গিয়েছিল। শুধু রাজা নয়, সকলেই এইভাবে যাচাই করে নিতেন নিজের সুরক্ষা। কেউ কেউ বলেন আসলে চিয়ার্সের নিয়ম চালু হয়েছে এই কারণে। তবে স্রেফ এটুকুই নয়, আরও অনেক কারণ রয়েছে।
কেউ কেউ বলেন পানের আগে শরীরের সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে মদটাকে উপভোগ করার জন্য এই নিয়ম। যেহেতু পান করা হবে তাই স্বাদ অনুভব হবে, চোখে দেখা যাচ্ছে তাই দর্শনেন্দ্রিয় কাজ করছে, বিশেষ গন্ধও রয়েছে মদের, যা অনায়াসে পাওয়া যায়। ছুঁয়ে দেখার অনুভূতিটাও স্বাভাবিক। কিন্তু শোনার কাজ নেই। মানে মদ্যপানে শ্রবণেন্দ্রিয়ের কোনও ভূমিকা নেই। সেখানেই আসে চিয়ার্স! মানে মদ খাওয়ার আগে র এই উল্লাস সকলেই কানে শুনতে পাবেন। তাতে পঞ্চেন্দ্রিয় সমান ভাবে মদ্যপানের সাক্ষী থাকল। এই যুক্তি অবশ্য অনেকেই মানতে চান না। বরং চিয়ার্স বলার সঙ্গে ভূত তাড়ানোর মিল খুঁজে পান অনেকে। এমন একটা ধারণা রয়েছে যে, মদের গন্ধে অনেকসময় অশরীরী আত্মা আকৃষ্ট হয়। তাদের দূরে সরাতেই চিয়ার্স বলা। এই শব্দে এমন কোনও জাদু রয়েছে যা অনায়াসে তাদের সরিয়ে দিতে পারে। এই সূত্র ধরেই কেউ কেউ বলেন মদ খাওয়ার আগে চিয়ার্স বলে সামান্য মদ মাটিতে ফেলে দেওয়া আসলে পূর্বপুরুষদের সম্মান জানানো। এ যেন তাঁদের উদ্দেশে নিবেদন করা। এই যুক্তিও তেমন মান্যতা পায় না। মোটের উপর নিরাপত্তার স্বার্থে চিয়ার্স বলা, এই তত্ত্বটাই অধিক প্রচলিত।
যদিও আজকাল চিয়ার্স যে স্রেফ মদের সঙ্গে সম্পর্কিত এমন নয়। বন্ধুদের সঙ্গে বসে চা-কফি খেতে গিয়েও অনেকে চিয়ার্স (History of Cheers) বলে ওঠেন। বন্ধুত্বের উদযাপন ছাড়া কিছুই না। রোজকার ব্যস্ত জীবনে সামান্য ফাঁক খুঁজে নিতেই বন্ধুদের জড়িয়ে ধরা। সেই আনন্দে চিয়ার্স বলে চিৎকার করলে ক্ষতি কি!