পরিযায়ী মানুষদের সর্বক্ষণ তাড়িয়ে বেড়ায় অনিশ্চয়তা। এক রাজ্যে বৃহত্তর পরিবার ফেলে রেখে দু’মুঠো ভাতের খোঁজে বাসা গড়তে হয় অন্য কোনও রাজ্যে। ফেলে আসা জায়গার সঙ্গে যোগসূত্র তারা ছিঁড়ে ফেলতে পারে না যেমন, তেমনই নতুন জায়গার সঙ্গে পাকাপাকি আত্মীয়তা জুড়তেও পারে না কোনওভাবেই। মূলধারার সমাজেও যেন অবাঞ্ছিতই থেকে যায় তারা।এক পরিযায়ী মেয়ের গল্পই এবার পাকাপাকি জায়গা পেল ক্লাস সিক্স-এর মালয়লাম টেক্সবুক-এ।
বর্তমানে পরিবার-সহ কেরালায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকেন ধারক্ষা পারভিন (Dharaksha Parveen)। ‘রোশনি প্রোজেক্ট’-এর অধীনে ছোট শিশুদের হাতের কাজ আর মালায়লাম ভাষা শেখান। এমন এক অতি সাধারণ মেয়ের পক্ষে কখনও কল্পনাতেও ভাবা সম্ভব হয়নি যে, তাঁর জীবনের কাহিনী ছাপার অক্ষরে জায়গা পাবে স্কুলের পাঠ্যবইতে। ধারক্ষা (Dharaksha Parveen)তো বরং আজীবন অস্বস্তিই পেয়েছেন তাঁর ফেলে আসা অতীত নিয়ে। মাত্র দশ বছর বয়সেই বিহারের জন্মভিটে ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল তাঁকে। পরের কয়েকটা বছর কেটেছিল পরিযায়ী হয়ে, মাথার উপর স্থায়ী ছাদ ছিল না বহুদিন। অবশেষে কেরলের মুপ্পাথডাম ঠান্ডিরিক্কাল কলোনি-তে নামমাত্র ঠাঁই মেলে।
পরিযায়ী মানুষদের সর্বক্ষণ তাড়িয়ে বেড়ায় এই অনিশ্চয়তা। এক রাজ্যে বৃহত্তর পরিবার ফেলে রেখে দু’মুঠো ভাতের খোঁজে বাসা গড়তে হয় অন্য কোনও রাজ্যে। সেখান থেকে বিতাড়িত হলে হয়তো আবার অন্য কোথাও। এর সঙ্গেই রয়ে যায় দেশের বাড়িতে টাকা পাঠানোর তাগিদ। ফেলে আসা জায়গার সঙ্গে যোগসূত্র তারা ছিঁড়ে ফেলতে পারে না যেমন, তেমনই নতুন জায়গার সঙ্গে পাকাপাকি আত্মীয়তা জুড়তেও পারে না কোনওভাবেই। মূলধারার সমাজেও যেন অবাঞ্ছিতই থেকে যায় তারা।
এক পরিযায়ী মেয়ের (Dharaksha Parveen) গল্পই এবার পাকাপাকি জায়গা পেল ক্লাস সিক্স-এর মালয়লাম টেক্সট বুক-এ। কীকরে? সে গল্পও বেশ অদ্ভুত। কেরালায় এসে রীতিমত সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছিল ধারক্ষাকে। যার মুখ্য কারণ, ভাষা। এখানকার ভাষাটি রপ্ত করতে কালঘাম ছুটে যাচ্ছিল তাঁর। নতুন জায়গা, নতুন মানুষ, নতুন খাদ্যভ্যাসের মতোই ভাষাটিও কিছুতেই বাগে আসছিল না। আর ঠিক তখনই তাঁর আঁধার জীবনে আলো এনে দেয় ‘রোশনি প্রোজেক্ট’। ছবিতে-কথা জাতীয় বইগুলো তো ছিলই, পাশপাশিই ছিল ধারক্ষার (Dharaksha Parveen)অদম্য জেদ। নাহলে যে মেয়ে একদিন মালয়লাম ভাষায় সামান্য অ-আ-টুকুই পড়তে পারত না, সে-ই এখন ছোটদের মালয়লাম শেখানোর দায়ভার সামলাচ্ছে। যেন রূপকথার গল্প!
আসলে ২৩ সালে ধারক্ষার (Dharaksha Parveen)জীবন ও সংগ্রাম নিয়ে এক টুকরো খবর ছাপানো হয়েছিল সেখানকার স্থানীয় কাগজে। সেই খবরই চোখে পড়ে পালাক্কড়-বাসী নারায়নান মাশ নামের এক ভদ্রলোকের। তিনি সদলবলে এসে যোগাযোগ করেন ধারক্ষার সঙ্গে। তাঁরা ওঁকে বলেন, একটি মালয়লাম পাঠ্যবইয়ের জন্য ইচ্ছেমতন কিছু লিখে দিতে। আর তখনই ধারক্ষা স্থির করেন, ছোটবেলার এক বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে চিঠি লিখবেন তিনি। শৈশবে বিহারের দ্বারভাঙা-এ ফেলে আসা এক বন্ধুর উদ্দেশে তাই চিঠি ছিলেন ধারক্ষা(Dharaksha Parveen)। চিঠিতে লিখলেন কেরালায় তাঁর জীবন কেমন কাটছে, সে কথা। এখনকার মানুষদের সঙ্গে গড়ে ওঠা সম্পর্ক, জীবনে ঘটা মনে রাখবার মতো ঘটনা ছাড়াও এ পরিযায়ী জীবনটির নানা চাওয়া-পাওয়ার কথা জায়গা পেল সেখানে।
পাঠ্যবইয়ে জায়গা পাচ্ছে ধারক্ষার (Dharaksha Parveen)জীবনের কথা, স্বাভাবিকভাবেই এতে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছেন তিনি। সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, জীবনে আরও বহুদূরের পথ পাড়ি দেওয়া এখনও বাকি রয়েছে তাঁর। তিনি আর্থিকভাবে বলীয়ান হয়ে প্রথমেই বাবা-মায়ের জন্য বাড়ি বানিয়ে দিতে চান। ধারক্ষার (Dharaksha Parveen)এমন মানসিকতা যে কেবল তাঁর অদম্য জেদের পরিচয় দেয়, তাই নয়। যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ মনে করে যে বাবা-মায়ের জন্য বাড়ি বানানোর দায়িত্ব কেবল ছেলে সন্তানের, তার চিরাচরিত ভাবনাতে প্রশ্নও তোলে।
ছোট ছোট পড়ুয়ারা এবার স্কুলে বসেই জানতে পারবে ধারক্ষার (Dharaksha Parveen)গল্পখানি। কেউ বা হয়তো মিলও পেয়ে যাবে নিজের জীবনের সঙ্গে! যে একাকিত্ব আশৈশব অনুভব করেছেন ধারক্ষা, তা এবার মনোবল যোগাবে অন্য কাউকে।