কোভিড-পরবর্তী সময়ে শুধু প্রাইভেট সেক্টর নয়, বেশিরভাগ স্কুল-কলেজ-অফিস কর্মচারীরাই ‘আপডেটেড’ থাকতে, জুড়ে গিয়েছেন নির্দিষ্ট অনলাইন মেসেজিং গ্রুপ-এ। যেখানে কাজের সময়ের আগে পরে যে কোনও সময়ে আলোচনা করা যেতে পারে কর্মক্ষেত্রের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে। ফলে মাথা জানান দিচ্ছে, ফোন তথা সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘অন’ হওয়া মানেই, বাধ্যতামূলকভাবে কাজের প্রসঙ্গগুলির সম্মুখীন হওয়া। তাই জেন-জি-র কাছে আর বিলাসিতা থাকছে না ‘ফোন ঘাঁটা’, বরং শূন্যতায় অনেক বেশি মুক্তি খুঁজে পাচ্ছে তারা।
ধরা যাক, সকালবেলার অফিসটাইম। মাঝারি ভিড়ে ভরা ট্রেন বা বাসে চড়ে আপনি চলেছেন গন্তব্যের দিকে। এমন সময়ে আপনার মুখোমুখির সিট-টি খালি হল, এবং সেখানে এসে বসল কমবয়সী একটি ছেলে বা মেয়ে। চেহারা দেখে আন্দাজ করা যায়, বয়স বছর সাতাশ-আটাশ মেরেকেটে। অর্থাৎ কিনা তাকে ‘জেন-জি’ বলা চলে। এখন দেখা গেল, ছেলেটি অথবা মেয়েটি বসে আছে তো আছেই। চুপচাপ হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে আপনার কিংবা অন্য কারও দিকে (Barebacking)। ফোন ঘাঁটছে না, বই বা খবরের কাগজও পড়ছে না। কিছুই করছে না সত্যি বলতে। আপনি বুঝতে পারেন যে কোনও কারণ নিয়ে নয়, নেহাতই অন্যমনস্ক হয়ে আপনার দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলেছে সে। তাও কেমন অস্বস্তি হচ্ছে এমন শুন্য দৃষ্টির সামনে বসে। ইচ্ছে করছে, সম্ভব হলে তার হাত ধরে টেনে বলেন, “ভাই, এভাবে বসে না থেকে কিছু তো অন্তত করো!”
শুনতে অদ্ভুত লাগলেও, সমীক্ষা জানাচ্ছে, জেন-জি প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে নাকি দ্রুত বাড়ছে এই প্রবণতা। অভিজ্ঞরা এর নাম দিয়েছেন ‘বেয়ারব্যাকিং’ (Barebacking)। ‘বেয়ারব্যাকার’ বলতে বোঝায় সেইসব মানুষ, ফাঁকা সময়ে শুন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া যাদের অন্য কিছুই করবার নেই। আর একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় যে এমনটা সবচাইতে বেশি ঘটছে এই তরুণ প্রজন্মের ক্ষেত্রে। কিন্তু কী এমন কারণ রয়েছে এর পিছনে? এ কি কোনও নতুন অসুখের আভাস, নাকি নেহাতই উঠতি ট্রেন্ড?
আরও শুনুন: মায়ার জঞ্জাল! ভেঙে যাওয়া প্রেমের উপহার নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে গোলাপি যান
জেন-জি বা জেনেরেশন জেড বলতে বোঝায়, ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যবর্তী সময়ের জাতকদের। যাদের নামে পূর্ববর্তী প্রজন্মদের একটাই অভিযোগ, জেন-জি ছেলেপিলেরা নাকি সর্বক্ষণ ফোনেই ডুবে থাকে। সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টে ক’টা লাইক-কমেন্ট হল, কোন ট্রেন্ড চলছে এখন, ঠিক কী করলে ‘ভাইরাল’ হওয়া যায়, এতেই তাদের বিশ্বসংসার সীমিত। তারা পাশের মানুষটির খবর রাখে না। অথচ দূরদেশের পোশাকআশাক, আদবকায়দা রপ্ত করবার প্রতি তীব্র আগ্রহ দেখায়। বিশ্বস্তরে জুড়তে গিয়ে ব্যক্তিস্তরে আরও বেশি একা হয়ে পড়ে।
এখন ভাবতে গেলেই বোঝা যায় যে, এই প্রজন্মের একেবারে শুরুর দিকে রয়েছে যারা – অর্থাৎ যাদের পড়াশুনার জীবন শেষ, বয়স চব্বিশ থেকে আটাশের মধ্যে – তাদের বেশিরভাগই হয়তো কর্মজীবনে প্রবেশ করে গিয়েছে। আর আধুনিক কর্মক্ষেত্র মানেই, তার মূল ভিত্তি প্রযুক্তিনির্ভর। ফলে অফিসে এলেই ছেলে বা মেয়েটির জন্য অপেক্ষা করছে একখানা চৌকোনা ডেস্কটপ আর পিঠ-সোজা চেয়ার। সারাদিন আলোর চোখে চোখ রেখে বসে থাকবার পর, দিনশেষে তার চোখ কেবল একটু বিশ্রাম চাইছে (Barebacking)। চলতি ট্রেন্ড কিংবা সরগরম খবরও তখন আর টানছে না তাকে।
এছাড়া, কোভিড-পরবর্তী সময়ে শুধু প্রাইভেট সেক্টর নয়, বেশিরভাগ স্কুল-কলেজ-অফিস কর্মচারীরাই ‘আপডেটেড’ থাকতে, জুড়ে গিয়েছেন নির্দিষ্ট অনলাইন মেসেজিং গ্রুপ-এ। যেখানে কাজের সময়ের আগে পরে যেকোনও সময়ে আলোচনা করা যেতে পারে কর্মক্ষেত্রের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে। ফলে মাথা জানান দিচ্ছে, ফোন তথা সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘অন’ হওয়া মানেই, বাধ্যতামূলকভাবে কাজের প্রসঙ্গগুলির সম্মুখীন হওয়া। অনেক ক্ষেত্রেই আবার আধুনিক কর্মক্ষেত্রের বেশ কিছু কাজের মূল ভিত্তিই সোশ্যাল মিডিয়া (যেমন সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাড বা মার্কেটিং)। কোম্পানি হয়তো নির্দ্বিধায় জানিয়ে দিচ্ছে কর্মচারীটিকে, যে, অফিস আওয়ারের পরেও তাকে সজাগ থাকতে হবে সবসময়ই। ফলে স্বাভাবিকভাবেই জেন-জি-র কাছে আর বিলাসিতা থাকছে না ‘ফোন ঘাঁটা’, বরং শুন্যতায় অনেক বেশি মুক্তি খুঁজে পাচ্ছে সে (Barebacking)। তাছাড়া, শান্ত মনে বই বা খবরের কাগজ পড়বার যে ধৈর্য, তা তো জেন-জি কবেই হারিয়েছে ফোন হাতে পেয়ে। এমনকি দরকারে বই বা খবরও সে ফোনেই পড়ে নিয়েছে।
আরও শুনুন: মানবতাই ধর্ম… বিধ্বস্ত পৃথিবীর ঘুরে দাঁড়ানোর সম্বল নতুন প্রজন্মের এই বিশ্বাস
অনেকে বলছেন, একদিকে ‘বেয়ারব্যাকিং’-এর (Barebacking) স্বভাব মন্দ কিছু নয়। ক্লান্তির ছুতোয় হলেও, অন্তত কিছুক্ষণ তো ডিজিটাল ডিটক্স অভ্যেস করছে তরুণ প্রজন্ম! কিন্তু বাস্তব কি সত্যিই এত সহজ? মানুষের আপাত ধীর জীবনের দু’দণ্ড শান্ত মনে বসে গান শোনা, বা একাগ্র চিত্তে বই পড়বার অভ্যেস সমূলে উপড়ে ফেলেছিল মোবাইল ফোনের আগমন। সেখানেও থেমে যায়নি। অল্প সময়ের তফাতেই একের পর এক হাই-স্পিড ফেসিলিটি এসে অপ্রয়োজনীয় করে তুলেছে আগেরটাকে। সিনেমা ছেড়ে ভিডিও, ভিডিও ছেড়ে রিল… মানুষ কেবল দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে চেয়েছে। আজ যখন দ্রুততাও ক্লান্তিকর হয়ে উঠছে তার কাছে, তখন কি কেবল শূন্যতার কাছেই আশ্রয় চাইছে সে? সৃজনশীলতার সবটুকু ভুলে মানুষও কি তবে যন্ত্রচালিত ‘বট’ হয়ে উঠবে আগামীতে! নাকি তা থেকে মুক্তি খোঁজারই পথই আসলে এই বেয়ারব্যাকিং!