মা বললেন, “আর না নবু, এবার পড়তে যাও।” নবু বলল, “বিকু আসুক।” “বিকুকে যেন দেখলাম খানিক আগে।” দরজার বাইরে গিয়ে নবু বিকুর নাম ধরে জোরে জোরে ডাক দিল। উঁকি মেরে দেখল, তাদের পড়ার ঘরে আলো জ্বলেনি। ঘরের মধ্যে গিয়ে বলল, “কই বিকু?”
মা বললেন, “ দেখলাম তো এল চোরের মতো পা টিপেটিপে, কোথায় গেছে বুঝি আবার! বিকু না পড়লে বুঝি তুই পড়বি না? যা পড়গে, যা। আর দেখ, অমন করে গলা ফাটিয়ে চ্যাঁচাসনে বিকু বিকু বলে, কানের পর্দা ফুটো করে দিবি নাকি সকলের?”
মা হাসতে হাসতে চলে গেলেন। ছোটো ভাই-বোনকে ক্যারামবোর্ডটি ছেড়ে দিয়ে নবু পড়ার ঘরে গিয়ে পড়তে বসাই স্থির করে ফেলল।
বিকুর ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারা যাচ্ছে না। নানারকম দ্বিধা-সন্দেহ নবুর মনে জাগতে থাকে। পরশু রাত্রে চুপিচুপি বিকুর মুখে লাল আর কালো কালি দিয়ে সে আলপনা এঁকে দিয়েছিল, সকালে বাড়িসুদ্ধ লোক হেসেছে। সেই থেকে একটু যেন কেমন কেমন হয়ে গেছে বিকু। প্রতিশোধ নেবার কথা ভাবছে সন্দেহ নেই। কোনদিক দিয়ে তার আক্রমণটা আসবে? নবু অত্যন্ত সতর্ক হয়ে আচে কাল থেকে।
এবার বিকুকে সে সহজে ছাড়বে না। এবার তার সঙ্গে লাগতে এলে বিকুকে সে এমন জব্দ করে দেবে—
কীসের শব্দ? পড়ার ঘোর ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। একটা জানালা দিয়ে এঘরে বারান্দার আলো থেকে আলো আসে, আর-একটা জানলা দিয়ে পাশের বাড়ি থেকে আলো আসে। সমস্ত জানালাগুলি বন্ধ না করলে তো এঘর এমন অন্ধকার হওয়ার কথা নয়। কে জানলা বন্ধ করেছে?
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে নবু এক মুহূর্তের জন্য একটু ইতস্তত করল। না, কাউকে ডাকা যায় না। মার বিছানা থেকে টর্চটাও আনা যায় না। বিকু হয়তো আশেপাশেই কোথাও আছে।
ঘরে ঢুকে নবু দেয়াল হাতড়ে আলোর সুইচটা টিপে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মধ্যে বিদ্যুৎ চমকানোর মতো চোখ ঝলসানো তীব্র আলো খেলে গিয়ে ঘরটা আবার অন্ধকার হয়ে গেল। হাই-পাওয়ারের বালব ফিউজ হওয়ার সময় যেমন ঘটে।
ঘরের মধ্যে কোথায় যেন একটা অদ্ভুত গম্ভীর গোঁয়াও গোঁয়াও আওয়াজ আরম্ভ হয়ে গেল, কালোয়াতি গানের রেকর্ড কেটে গেলে গ্রামোফোনে যেমন আওয়াজ হয়। আর দেখা গেল, ঘরের কোণে শুন্যে ঝুলানো দুটো চোখ আর একটা মুখ; পথে গাড়ি নিয়ন্ত্রণের নীল আর লাল আলোর মতো চোখ দুটি গাঢ় নীল আর মুখটা গাঢ় লাল।
তারপর কী হল শুনুন…
লেখা: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
পাঠ: কোরক সামন্ত
আবহ: শঙ্খ বিশ্বাস