শীতের আনন্দ বাড়ে চড়ুইভাতির আঁচে। অবসরযাপন শুধু নয়, এ হল হাতে হাত রেখে বাঁচতে শেখার প্রথম পাঠ। খাওয়া আর খাওয়ানোর আনন্দের এমন যুগলবন্দি আর কোথায়! বাঙালির শীত-পরবে তাই চড়ুইভাতি থাকেই। বদলে যাওয়া দিনকালে স্মৃতির ভাঁজে জমা থাকে অনাবিল আনন্দের সেই সব মুহূর্তরা। চড়ুইভাতি বলা হোক বা পিকনিক, কী অর্থ নিয়ে ধরা দেয় আজকের প্রজন্মের কাছে? সে-কথাই শোনালেন অভিনেতা ঋতব্রত মুখোপাধ্যায় এবং অভিনেত্রী রাজনন্দিনী পাল। সেকাল থেকে একাল- তথ্য তালাশ করে চড়ুইভাতির কিস্সা সাজালেন শুভদীপ রায়। শোনালেন চৈতালী বক্সী ও শঙ্খ বিশ্বাস। শব্দগ্রহণ- অঙ্কুর নন্দী।
কথায় আছে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ! তবে সেই পার্বণে সবসময় যে দৈবের ছোঁয়া থাকে তা কিন্তু নয়। যা থাকে তা হলো একসঙ্গে মিলেমিশে উদযাপন করার কিছু উপায়। ঠিক যেরকম এক হওয়ার এক উৎসবের নাম ‘চড়ুইভাতি’। যা অলিখিত ভাবে বাঙালির তেরো পার্বনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। কখনও টেনিদার গল্পে কখনও রবি ঠাকুরের কবিতায়, বাংলা সাহিত্যে এই চড়ুইভাতি নিয়ে গল্পের ভাঁড়ার চিরকাল পরিপূর্ণই থেকেছে। বলা চলে, বেশিরভাগ লেখাতেই নিজেদের জীবনের কিছু স্মৃতি ধরে রেখেছেন এই মহানুভবেরা। তবে এই চড়ুইভাতি শব্দটা কোথা থেকে এসেছে এই নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। কেউ বলেন, চড়াই পাখির সঙ্গে এই শব্দের বুৎপত্তিগত যোগ রয়েছে। কেউ বলেন লৌকিক দেবীর পুজোর সঙ্গে এর যোগ রয়েছে। তবে এসবের কোনও লিখিত ব্যাখ্যা নেই বললেই চলে। আবার এই প্রসঙ্গে অভিধান ঘাঁটলে দেখা যাবে উনিশ শতকের আগে এমন কোনও শব্দেরই খোঁজ নেই। সর্বপ্রথম জ্ঞানেন্দ্রমোহন বা হরিচরণের অভিধানে এই চড়ুইভাতি শব্দেটির উল্লেখ মেলে। সেখানে অবশ্য এর অর্থ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন ‘বনভোজন’ নামে আরও একটি শব্দের। অন্যদিকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘শব্দসংগ্রহ’ নামক সঙ্কলনে ‘চড়ুইভাতি’ শব্দটি থাকলেও ‘বনভোজন’ শব্দের কোনও উল্লেখ নেই। বর্তমানে আবার এই দুটি শব্দই প্রায় হারিয়ে গিয়ে হয়েছে পিকনিক। সেকথা স্পষ্ট ভাবেই জানিয়েছেন অভিনেতা ঋতব্রত ও অভিনেত্রী রাজনন্দিনী। এই চড়ুইভাতিকে তাঁরা পিকনিক বলতেই বেশি স্বচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তবে নাম নিয়ে যতই তর্ক চলুক একসঙ্গে মিলেমিশে আনন্দ করায় কোনও তফাৎ থাকে না চড়ুইভাতি বা পিকনিকে।
আরও শুনুন: মিঠে শীতে পিঠের পাঁচালি… শুধু রসনাবিলাস নয়, স্বাদের আড়ালে খোঁজ সংস্কৃতিরও
তবে আপেক্ষিক অর্থে যতই এক হোক, পিকনিকের জন্ম কিন্তু বাংলায় নয়। অভিধান অনুসারে, পিকনিক একটি ফরাসি শব্দ। যার অর্থ ‘প্রকৃতির কোলে বসে খাওয়া দাওয়া আর হৈ হুল্লোড় করা।’ খাওয়া দাওয়া বলতে অবশ্য প্রতিদিন যা খাওয়া হয় তার থেকে একটু আলাদা কিছু। আর ‘প্রকৃতির কোলে’ বলতে নদী তীর,গ্রামের প্রান্তে একটুকরো ময়দান অথবা সবুজে ঘেরা বনভূমিই চড়ুইভাতির আদর্শ জায়গা। এককালে রাজা-বাদশারা ছেলেপুলে সৈন্যসামন্ত নিয়ে বনে-জঙ্গলে ভোজনের আয়োজন করতেন। বলা যায় তখন থেকেই চড়ুইভাতির নাম হয়ে যায় বনভোজন। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে সেই বনভোজনের রূপও। সেকথায় সম্মতি জানিয়েছেন অভিনেতা ঋতব্রতও। পিকনিকের স্মৃতিচারণায় তিনি নিজের পাড়ার কথা বলেছেন। কীভাবে পাড়ার কাকা জ্যাঠারা পিকনিকের দিন সম্পূর্ণ অন্য এক অবতারে ধরা দিতেন সেকথা ভারী মজা করেই জানিয়েছেন অভিনেতা।
আরও শুনুন: ছুটি : শুনুন নাটক ‘বসে আঁকো’, অভিনয়ে সোহিনী সরকার ও অম্বরীশ ভট্টাচার্য
তবে একথা মানতেই হবে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যতই বাহ্যিক ধরন বদলাক, চড়ুইভাতি বা পিকনিকের জন্য অপেক্ষা করেন না এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া কঠিন। শুধু বাঙালি বললে অবশ্য ভুল হবে। সামাজিক জীব হিসেবে যে কোনও মানুষই সদলবলে আনন্দ করতে পছন্দ করেন। যে আক্ষেপ ধরা পড়েছে অভিনেত্রী রাজনন্দিনী পালের কথায়। বিগত বছর গুলিতে বিভিন্ন কারণে তিনি পিকনিকে যেতে পারেননি। অথচ ছোটবেলায় নাকি বেশ কয়েকবার পিকনিকে যাওয়ার সুযোগ হতো তাঁর। তাই তো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শীতকাল পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই পিকনিকের প্ল্যান করতে শুরু করে দেন সকলে। আর সেই বৃত্ত ছোট হতে হতে বাংলায় এসে পৌঁছালে বোঝা যায় চড়ুইভাতি নিয়ে বাঙালি ঠিক কতটা আবেগপ্রবণ। বিশেষত কলকাতার ময়দান কিংবা বিশেষ কোনও পার্ক, যেকোনও জায়গাতেই বছরের এই সময়টাতে ভিড় থাকে চোখে পড়ার মতো। আসলে চড়ুইভাতি তো শুধু অবসরের আনন্দ নয়, হাতে-হাত রেখে কাজ করা আর আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার প্রথম পাঠ-ও।