সাতের দশকের পশ্চিমবঙ্গ, ঘোরতর নকশাল আমল। কলকাতার আনাচে-কানাচে ধর-পাকড়, গুলির শব্দ, বাতাসে বারুদের গন্ধ আর ঘরে ঘরে কান্নার হাহাকার।
টালিগঞ্জ অঞ্চলের নিউ থিয়েটার্সে ‘বনপলাশীর পদাবলী’ সিনেমার শুটিং চলছে। একদল লোক হঠাৎই ঢুকে আসে স্টুডিয়োতে। পাইপ গান তাক করে উত্তম’কে বলেন তাঁদের মিছিলে যেতে হবে। পুলিশি নৃশংসতায় বহু তরুণের নকশাল সন্দেহে হত্যা, তারই প্রতিবাদে এই মিছিল। রাজি হননি উত্তমকুমার। যথারীতি বাড়তে থাকে হুমকি। সেদিন তাঁর সামনে ছিল কাঁচের জলের গ্লাস! উত্তেজনায় উত্তমের হাতে লেগে পড়ে যায় সেই গ্লাস, আর তাতেই খানিক চমকে ওঠেন বন্দুকধারীরা, কেটে যায় ঘোর। নাহলে কি হত বলা মুশকিল।
সেট থেকেই কোনোক্রমে তৎপরতার সঙ্গে তাঁকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। সুপ্রিয়া দেবী সেদিন উপস্থিত ছিলেন না। বাড়ি ফেরার পথে এবং বাড়ি ফেরার পর একাধিকবার তাঁর কাছে আসে ফোন, রিসিভার তুললে একটাই কথা, ‘‘পালিয়ে বাঁচবেন ভেবেছেন?’’ বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে? বাস্তবে এমনটাই ঘটেছিল সেইসময়ের হার্টথ্রবের সঙ্গে। ‘নায়ক’-ছায়াছবির অরিন্দম কি ভেবেছিলেন তাঁর সঙ্গে বাস্তবে এমনটা ঘটবে?
মিছিলে না গেলে উত্তমকুমারের কাটামুণ্ডু ঝুলবে টলিপাড়ায়!
এমনটাই নাকি চাউর হয়েছিল সত্তর-একাত্তরের সেই ভয়াবহ সময়ে। কারণ? ময়দানে প্রাতঃভ্রমণে যেতেন উত্তম। একদিন নাকি তিনি এক পুলিশি হত্যাদৃশ্য দেখে ফেলেন!
ভাবুন তো! ময়দান, কলকাতা ময়দান, তিলোত্তমার প্রাণকেন্দ্র; সেইখানে মৃত্যুদৃশ্য! ভুললে চলবে না, সময়টা ছিল সত্তরের দশক। ময়দানে এরকম পরিচিত-অপরিচিত বহু লাশ পড়ে থাকা বোধহয় খুব একটা অস্বাভাবিক ছিল না সেইসময়। ভোরের কুয়াশা হোক বা বিকেলের আলো, কলকাতা ময়দান এরকম বহু মৃত্যুর সাক্ষী হয়েছে বারবার।
ভোরের ময়দান, স্বাভাবিকভাবেই খানিক জনমানবশূন্য হওয়ারই কথা, অথচ সেই হত্যা মুহূর্তের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন নাকি উত্তমকুমার, বাঙালির ম্যাটিনি আইডল! যদিও মৃত্যুর ইতি এখানেই হয় না। শোনা যায়, দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসাররা নাকি মহানায়ক-কে মিষ্টি কথায় সাবধান করে দিয়ে গিয়েছিলেন–“আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি।”
ভাগ্যিস তিনি উত্তমকুমার, নাহলে এইসব দৃশ্যের সাক্ষী রাখা হয় নাকি?
লেখা: বিতান দে
পাঠ: সুশোভন প্রামাণিক
আবহ: শঙ্খ বিশ্বাস