পোর্ট কমিশনের কেরানি থেকে রুপোলি পর্দার নায়ক। খ্যাতির শীর্ষে থাকা মানুষটির এক চিলতে হাসিতেই উত্তাল ছিল আপামর বাংলা। কয়েক দশক ধরে বাঙালির মনে ঝড় তোলা নায়ক উত্তমকুমার। তাঁর জীবনে ঝড় এসেছে বহুবার। বিধ্বস্ত হয়েছেন, কিন্তু আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। এক মুহূর্তও মহানায়কের পাশ থেকে সরে যাননি তাঁর ভালবাসার সেই মানুষটি। ওঁদের জীবনের সেইসব ভাঙাগড়া-ওঠাপড়ার মুহূর্ত খুব কাছ থেকে দেখেছেন আরও এক নায়ক। উত্তমকুমারের প্রিয় বিশু, বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়। সোনালি দিনের সেইসব স্মৃতির কথা মেলে ধরলেন, টিম ‘শোনো’-কে, সাক্ষী রইলেন শ্যামশ্রী সাহা।
‘নায়ক’ ছবির সেই আইকনিক দৃশ্যের কথা মনে আছে? যেখানে টাকার অতলে তলিয়ে যাচ্ছেন নায়ক অরিন্দম। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন, কিন্তু পারছেন না। বাস্তবে নায়ক উত্তমকুমার এই ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলেন বারবার। একদিকে খ্যাতির আলো, অন্যদিকে তারই নিচে ঘনিয়ে উঠেছিল দাম্পত্যের অন্ধকার। ‘সপ্তপদী’, ‘অগ্নীশ্বর’, ‘ঝিন্দের বন্দী’ পরপর সফল সব ছবি। খ্যাতির শিখরে উঠতে থাকা মহানায়কের দাম্পত্যে অজান্তেই ধরেছিল ঘুণপোকা। যে গৌরীর ইচ্ছে আর প্রশ্রয়ে সিনেমা জগতে আসা, সেই গৌরীর বিদ্রোহের আগুনে বহ্নি-পতঙ্গ হতে হয়েছিল মহানায়ক-কে।
১৯৬৩-র ২৭ সেপ্টেম্বর। সকাল থেকেই গিরীশ মুখার্জি রোডের বাড়িতে শুরু হয়েছে সাজো সাজো রব। উপলক্ষ: তাঁর জন্মদিন। ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে দরজা থেকে বাড়ির অন্দরমহল। হাসি-মশকরা-খুনসুটিতে গমগম করছে সারা বাড়ি। অভিনেতা-অভিনেত্রী-পরিচালক-সুরকার-গীতিকারে ভরে উঠেছিল বাড়ির বৈঠকখানা। উত্তমের দেওয়া শাড়িতে সেজেছিলেন গৌরীদেবী। সাদা পাঞ্জাবি আর পাজামায় আড়ম্বরহীন কিন্তু রাজকীয় সাজে উত্তম স্বয়ং। হঠাৎ গৌরীদেবীর কটাক্ষে বদলে গেল পরিবেশ, নিমেষেই যেন কালবৈশাখী ঘনিয়ে এল। সেই রাতেই মায়ের অনুরোধ উপেক্ষা করে এক পোশাকে বাড়ি ছাড়লেন উত্তম। গাড়ি সোজা এসে থামল ময়রা স্ট্রিটে। দরজা খুললেন উত্তমের প্রিয় বেণু, সুপ্রিয়া দেবী। ওঁর মুখ দেখে মনে হল যেন এই দিনটির জন্যই প্রস্তুত ছিলেন। ‘আমাকে এখানে থাকতে দেবে বেণু?’ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মহানায়ককে সোহাগে-আদরে কাছে টেনে নিয়েছিলেন বেণু। ঘরে ঢুকে উত্তম দেখেন, টেবিলে সাজানো রয়েছে খাবার। বাথরুমে তাঁর জন্য, তাঁর তোয়ালে, পছন্দের সাবান এমনকী, যে রেজর ব্যবহার করেন সেটিও!
একদিকে গৌরীদেবী, অন্যদিকে বেণু, দু’জনেরই খুব কাছের ছিলেন বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়। কলকাতা থাকলে পালা করে যেতে হতো দু’বাড়িতেই। দু’জনেই রান্না করে খাওয়াতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলত আড্ডা। ওই সময় বিশ্বজিৎ ছিলেন বোম্বেতে। ঘটনা শুনেই ফোন করেছিলেন, প্রিয় দাদাকে। বিধ্বস্ত মহানায়ক টেলিফোনের ওপার থেকে কাতর স্বরে জানিয়েছিলেন, ‘তুই জানিস না বিশু, কী অত্যাচার হয়েছে আমার উপর!’
লেখা: শ্যামশ্রী সাহা
পাঠ: শঙ্খ বিশ্বাস