লোকেশনের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে জঁ রেনোয়াঁ সত্যজিৎকে সরাসরি জিজ্ঞেসই করেন, ‘তুমি নিশ্চয়ই ছবি বানাতে চাও, তাই না?’ সত্যজিৎ খানিক আনাড়ির মতো হেসে বলেছিলেন ‘হ্যাঁ’। আর তারপর ‘পথের পাঁচালী’র গল্প বলেছিলেন সংক্ষেপে। গাড়ীতে করে ঘুরতে ঘুরতে সত্যজিৎ ভাবছিলেন সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত ‘আম আটির ভেঁপু’র কথা। রেনোয়াঁ শেখাচ্ছেন বাস্তবকে নতুন করে দেখতে। আর সত্যজিতের মাথায় ডিকের সেই কথা, এর থেকে কিন্তু বেশ ভাল ফিল্ম হয়!
বিখ্যাত ফরাসী চিত্রপরিচালক জঁ রেনায়াঁ ও তাঁর ছবি, ভাবনাচিন্তা, দর্শন যেন একাকার সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’র উপস্থাপনায়। কীভাবে ঘটল এই আশ্চর্য সংমিশ্রণ? আসুন স্মৃতির সরণিতে হাঁটা লাগিয়ে আসি একবার।
১৯৪৯। দু’বছর হল স্বাধীন হয়েছে দেশ, একই সঙ্গে হয়েছে দু’খণ্ডও। ওপার বাংলা থেকে আগত অসংখ্য মানুষের ঢল তখন কলকাতার রাস্তায়। চারের দশকের শেষ, উত্তাল সময়। গান্ধী খুন হয়েছেন মাত্র একবছর, ধর্মের গোড়ায় সুড়সুড়ি দিয়ে রাজনীতি চলছে তলায় তলায়।
এসবের মাঝেই এক তরুণ, যিনি আপাতভাবে রাজনীতিতে ততটাও উৎসাহী ছিলেন না প্রথম জীবনে, নীরবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সম্পূর্ণ অন্য এক জগতের। ফিল্ম জগতের। সঙ্গে তুমুল উৎসাহ ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল মিউজিকে, রেকর্ড জোগাড় করার ঝোঁকে প্রায়ই ঘুরে বেড়ান চোরাবাজারে। প্রতি শনিবার নিয়ম করে দেখেন ফিল্ম। কলকাতায় তখন হলিউডের ছবি সরাসরি মুক্তি পেত। জন ফোর্ড, উইলিয়াম ওয়াইলার, ফ্রাঙ্ক কাপরা ক্রমশ প্রিয় হয়ে উঠছে তাঁর।
ফিল্ম দেখা চলছে। তদ্দিনে অবশ্য চাকরি নিয়েছেন এক বিজ্ঞাপন সংস্থায়, সঙ্গে কাজ করছেন বাংলা প্রকাশনা সংস্থায় সদ্যপ্রতিষ্ঠিত সাড়া জাগানো পাবলিকেশন ‘সিগনেট প্রেস’-এ, বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকার কাজ। সেই প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধার ডি. কে. গুপ্ত– যাঁকে ‘ডিকে’ নামে চেনেন সবাই, তাঁর অত্যন্ত স্নেহের পাত্র হয়ে উঠেছেন এই তরুণ। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস সংক্ষিপ্তাকারে ‘আম আটির ভেঁপু’ নাম দিয়ে প্রকাশ করবেন বলে ঠিক করলেন ডিকে। পাতায় পাতায় ছবি আঁকার দায়িত্ব পড়ল এই তরুণের। কিন্তু এখানে বাঁধল গো! বাবা-ঠাকুরদা বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত জরুরি দুই ব্যক্তিত্ব হলেও তিনি মোটেই সাহিত্য পড়েননি সেভাবে। কিছু ইংরেজি থ্রিলার উপন্যাস ছাড়া। প্রায় ধমকধামক দিয়ে ডিকে ওঁকে ‘পথের পাঁচালী’ পড়তে বললেন। প্রকাশিতব্য বই নিয়ে আলগোছে মন্তব্য করলেন, এর থেকে কিন্তু বেশ ভাল ফিল্ম হয়!
লেখা: সায়ন্তন দত্ত
পাঠ: শঙ্খ বিশ্বাস
আবহ: শঙ্খ বিশ্বাস