ভারতীয় সংগীতের ইতিহাসে বরাবরই ব্যতিক্রমী ছাপ রেখেছিলেন জগজিৎ ও চিত্রা সিং। গজল সংগীতকে অন্য মাত্রা দিয়েছিলেন তাঁরা। সম্মান খ্যাতি পেয়েছেন যতটা, আঘাত ও শোক পেয়েছেন ঠিক ততটাই।
দীর্ঘদিন ধরে বৈবাহিক সম্পর্কে জটিলতার জেরে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন চিত্রা। বিবাহবিচ্ছিন্না চিত্রাকে যখন বিয়ে করেন জগজিৎ, মণিকার বয়স মাত্র ছয়। ভারতীয় লঘু ও শাস্ত্রীয় সংগীতের অলিন্দে এই প্রথিতযশা দম্পতির উত্থান ও জীবন যাপন রূপকথাকেও হার মানায়। বারবার আঘাত এসেছে তাঁদের জীবনে। জীবনসায়াহ্ন স্বস্তি দেয়নি সিং দম্পতিকে। বিবেকের মৃত্যুর পর ২০০৯ সালে আত্মঘাতী হন চিত্রা সিংয়ের প্রথম পক্ষের কন্যা মণিকা চৌধুরীও। নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি ভালবাসতেন জগজিৎ। মণিকা ও বিবেক দু’জনেই ছিলেন ‘পাপা’র চোখের মণি। কিন্তু জীবদ্দশায় দুই সন্তানকেই হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যান দম্পতি। চিত্রা অনেক আগেই সরিয়ে নেন নিজেকে। শান্তির খোঁজে আধ্যাত্মিক জগতে মনোনিবেশ করেন। জগজিৎ তাতে কখনও বাধা দেননি। অবশেষে মেয়ের মৃত্যুর দু’বছরের মাথায় ২০১১ সালের ১০ অক্টোবর মুম্বইতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন গজল সম্রাট জগজিৎ সিং। দু’দিন পরেই লন্ডনে বিখ্যাত গজল শিল্পী গুলাম আলির সঙ্গে তাঁর একটি প্রোগ্রাম হওয়ার কথা ছিল। এই দুঃসংবাদ পেয়ে অনুষ্ঠান বাতিল করে দেন গুলাম আলি। চোখের জলে ভেসে জানিয়েছিলেন, ‘মেহদি হাসান যখন মারা যান গজলের আত্মাও তার সঙ্গে চলে গিয়েছিল। যা কিছু অবশিষ্ট ছিল তা এবার জগজিৎ নিয়ে গেলেন।’
প্রায় এক দশক হতে চলল বন্ধ হয়ে গিয়েছে হারমোনিয়াম। বান্দ্রা ওয়েস্টের পেরি ক্রস রোডের সেই বাড়ি থেকে আর শোনা যায় না গজলের সুর। শোনা যায় না জলদ্গম্ভীর কণ্ঠের রেওয়াজ। এখন শুধু সেখানে স্মৃতির পাহাড় আঁকড়ে বেঁচে আছেন পঁচাত্তরবর্ষীয়া চিত্রা সিং। বহুদিন হল সংগীতকে আলভিদা জানিয়েছেন।
শেষবার তাঁকে দেখা যায় ২০১৭ সালে, বেনারসে সংকটমোচন সংগীত সমারোহে অংশ নিতে। রাজকীয় সম্বর্ধনা দেওয়া হয় তাঁকে। মন্দিরের কর্মকর্তারা অনেক করে সাধাসাধি করেছিলেন তাঁকে অন্তত একটা গান শোনানোর জন্য। মাইক হাতে কান্নায় ভেঙে পড়েন চিত্রা সিং। বলেন, ‘সব সুর মরে গেছে। এখন আমি নিঃস্ব। আমাকে ক্ষমা করবেন।’
বাকিটা শুনে নিন…
লেখা: প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত
পাঠ: শ্যামশ্রী সাহা
আবহ: শঙ্খ বিশ্বাস