চলতি বছরের মার্চ মাসে বিসিসিআই-এর পক্ষ থেকে যে নির্দেশিকা বেরোয়, তাতে জানান হয় যে ৪৫ দিনের ট্যুরে কোনওমতেই ১৪ দিনের চাইতে বেশি ‘ফ্যামিলি টাইম’ দেওয়া যাবে না খেলোয়াড়দের। আর এ নিয়েই দ্বিমত প্রকাশ করেন বিরাট। তিনি সাফ জানিয়ে দেন যে, একজন মানুষের জীবনে তার পরিবারের গুরুত্ব কতখানি, তা কখনওই সকলকে বলে বোঝানো সম্ভব নয়! এ সময়ে তাঁর মন্তব্যটি নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি।
পরিবারের সঙ্গে পেশাদারিত্বের এক চিরকালীন বিরোধ যেন রয়েই যায়। যেন কোনও এক সময়ে যে কোনও একটাকেই বেছে নিতে পারবে মানুষ। অথচ পরিবারকে ভালো রাখতেই তো পেশার ঝক্কি মাথায় নেওয়া! তবে কেন পরিবারকে সময় দিতে চাইলে, চূড়ান্ত পেশাদার ব্যক্তিকেও সমস্যায় পড়তে হয়? সম্প্রতি অভিনেত্রী দীপিকা পাডুকোনের (Deepika Padukone) সঙ্গে পরিচালক সন্দীপ রেড্ডি ভাঙ্গার যে বচসা ঘিরে রীতিমত উত্তপ্ত সোশ্যাল মিডিয়া, তাতেই নতুন করে উঠে আসে এহেন আলোচনা।
সদ্যোজাত কন্যাকে সময় দিতে চান, তাই দিনে ছয় ঘণ্টার বেশি কাজ করতে রাজি নন দীপিকা। ‘স্পিরিট’ সিনেমার পরিচালক সন্দীপ রেড্ডি ভাঙ্গাকে এমনটাই জানানো হয় অভিনেত্রীর পক্ষ থেকে। এমনকি শ্যুটিংয়ের সময়কাল যদি ১০০ দিনের বেশি হয়ে যায়, তবে প্রত্যেক দিনের জন্য বাড়তি টাকা দিতে হবে অভিনেত্রীকে। জানা যায়, এর জেরেই নাকি বচসা বাধে দুই তরফের মধ্যে। আর দীপিকা পাডুকোনকে একপ্রকার বাতিল করেই সে জায়গায় অন্য অভিনেত্রী নির্বাচন করেন ভাঙ্গা।
আর তাই প্রশ্ন ওঠে, সত্যিই কি পরিবারকে সময় দিতে চাইলে কোনও ব্যক্তিকে অপেশাদার বলে গণ্য করা যেতে পারে? দীপিকাই (Deepika Padukone) তো প্রথম নন। এর আগেও ‘ফ্যামিলি টাইম’ বেছে নেওয়ার জন্য জনগণের কটাক্ষের মুখে পড়তে হয়েছে অন্যান্য ক্ষেত্রের তারকাদেরও। ২০২৪ সালে ‘বর্ডার-গাভাসকর ট্রফি’-র সময় বাদবাকি দলের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া যাননি রোহিত শর্মা। মুম্বইতে থেকে গিয়েছিলেন, কারণ সে সময় তাঁর স্ত্রী ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের পরেই রোহিত শর্মা ফের কাজে যোগদান করেন। তাঁর দক্ষতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠার কথাই নয়, অথচ এই সামান্য দেরির জন্য সাধারণের রোষানলে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। ক্রিকেটের প্রতি তিনি কতখানি নিবেদিতপ্রাণ, তা নিয়ে কাটাছেঁড়াও কম হয়নি সে সময়ে।
একইরকম কটাক্ষের মুখোমুখি হতে হয়েছিল বিরাট কোহলিকেও। চলতি বছরের মার্চ মাসে বিসিসিআই-এর পক্ষ থেকে যে নির্দেশিকা বেরোয়, তাতে জানান হয় যে ৪৫ দিনের ট্যুরে কোনওমতেই ১৪ দিনের চাইতে বেশি ‘ফ্যামিলি টাইম’ দেওয়া যাবে না খেলোয়াড়দের। আর এ নিয়েই দ্বিমত প্রকাশ করেন বিরাট। তিনি সাফ জানিয়ে দেন যে, একজন মানুষের জীবনে তার পরিবারের গুরুত্ব কতখানি, তা কখনওই সকলকে বলে বোঝানো সম্ভব নয়! এ সময়ে তাঁর মন্তব্যটি নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি। নেটনাগরিকদের একাংশ পরিবারের প্রতি বিরাটের ভালোবাসার প্রশংসা করলেও অনেকেই তাঁর আচরণকে দুর্বলতা বলে আখ্যা দেন।
মানুষের এমনধারা ভাবনার পিছনে কোথাও হয়তো রয়ে যায় শ্যভিনিজমের রেশ। যা মানবচরিত্রের যাবতীয় কমনীয়তাকে দুর্বলতা বলে দাগিয়ে দিতে চায়। তাই হয়তো নামী বহুজাতিক সংস্থার কর্ণধার, কর্মীদের কাজের সময় বাড়ানোর প্রসঙ্গে কৌতুকের ছলে বলে বসেন, বাড়িতে বসে একনাগাড়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকার চাইতে অফিসে আসা ভালো! যেন নিজেকে পেশাদার প্রমাণ করতে চাইলে, কোনওভাবেই পরিবারের প্রতি দুর্বলতা দেখানো যাবে না!
অথচ পরিবারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সময় কাটানোর ইচ্ছা যে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ, তা কেবল অনুমান নয়। সত্যিই এমনটা মনে করেন মনোবিদরা। হয়তো এ জন্যই ‘মেন্টাল ওয়েলবিইং’ নিয়েও উদাসীনতারই পথ ধরে আপাত পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। তবে বিতর্কের জায়গা থেকে যায় সেখানেও। ব্যস্ত জীবনে পরিবারের জন্য ঠিক কতখানি সময় তুলে রাখা উচিত, ঠিক কতখানি সময় কাজের জায়গায় দেওয়ার পরেও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পারে মানুষ, সে আলোচনা বোধহয় সহজে মেটার নয়।