সুরাপ্রেমীরা বলেন, ব্র্যান্ড নামী–দামি অনেক আছে, কিন্তু ‘ওল্ড মঙ্ক’ বা ‘বুড়ো-সাধু’ একটা ইমোশন, এক নাছোড়বান্দা আবেগ।
কিন্তু এই রামের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে যদি জুড়ে যায় গুমনামি বাবার নাম? সে বিষয়ে আসুন একটু গপ্পো করা যাক।
১৮২০। তখন ভারতে ইংরেজদের রমরমা। স্কটিশ ব্যবসায়ী এডওয়ার্ড ডায়ার ভারতে আসেন নিজের ব্যবসা–ভাগ্য পরখ করতে। একেই এখানে গরম আবহাওয়া, তার ওপর বিদেশ থেকে সোডা এবং হুইস্কি আনিয়ে তবেই পান করা যায়। সে তুলনায় বরফের তোয়ালে জড়িয়ে, অথবা ছায়াওয়ালা কুয়োর জলে চুবিয়ে রেখে বিয়ার উপভোগ করা যায় বেশ। তাই বিদেশিদের মধ্যে, বিশেষত ব্রিটিশদের মধ্যে পানীয় হিসেবে বিয়ারের চাহিদা বাড়ছিল। জন ল্যাং–এর বই ‘দ্য হিমালয়ান ক্লাব’ থেকে জানা যায়, তখনকার সময়ে ব্রিটিশদের অবসরকালীন আবাস ছিল সিমলা, মানালি, ধরমশালার মতো জায়গাগুলো। গ্রীষ্মকাল এলেই তল্পিতল্পা বেঁধে তাঁরা পাহাড়ে ওপরকার জনপদগুলোতে উঠে যান। শীত পড়লেই ফের উপত্যকায় নেমে আসেন। এডওয়ার্ড ডায়ার ব্যবসার এই সুবর্ণসুযোগ হাতছাড়া করলেন না। ১৮৫৫–এ তিনি কসৌলিতে বানিয়ে ফেললেন ভারতের প্রথম ‘ব্রিউয়ারি’। নাম রাখলেন, ‘কসৌলি ডিস্টিলারি কোম্পানি’। সেখানেই তৈরি হল, ভারত তথা এশিয়ার প্রথম বিয়ার— লায়ন।
এরপর আর এক বিদেশি সাহেব এইচ. জি. ম্যাকিন, ভারতে আসেন ১৮৮৭ সালে। তিনি ডায়ার-এর কাছ থেকে সোলান এবং পুরনো সিমলার ব্রিউয়ারি কেনেন। সেই সময়েই এই দুই সংস্থা মিলে তৈরি হয় ‘ডায়ার এন্ড ম্যাকিন কোং লিমিটেড’।
১৯৪৯ সালে নরেন্দ্রনাথ মোহন ‘ডায়ার এন্ড ম্যাকিন কোং লিমিটেড’–এর মালিক হন। তাঁর পর ব্যবসার হাল ধরেন ছেলে কর্নেল বেদ রতন মোহন। কোম্পানির নাম বদলে হয় ‘মোহন ম্যাকেন প্রাইভেট লিমিটেড’।
১৯৫৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর মোহন ম্যাকেন প্রাইভেট লিমিটেড-এর সুরা ‘ওল্ড মঙ্ক’ বাজারে আত্মপ্রকাশ করে। সে সময় বাজার কাঁপাচ্ছিল হারকিউলিস রাম। বুড়ো সাধু এসে এক পাঞ্চেই হারকিউলিসকে নক আউট করে।
এই কালো স্বাদু জাদু পানীয়ের রেসিপির মধ্যেই আছে এক নিজস্বতা। আখের রস, এবং আখের গুড় সঙ্গে ঝরনার জল মিশিয়ে, সাধারণ ভাবে বেশ কিছুদিন রেখে দেওয়া হয়। তারপর এর সাথে ইস্ট মিশিয়ে আরও খানিক গেঁজিয়ে। ভ্যানিলার স্বাদ আর গন্ধ মিশিয়ে পেট মোটা ওক গাছের পিপেতে বন্দি করে রাখা হয় পাক্কা সাত বছর। তারপর পিপে থেকে আর এক প্রস্থ শোধন করে বোতলে পোরা হয়।
ওল্ড মঙ্কের এই জনপ্রিয়তার নেপথ্যে রয়েছেন, আরও এক সেনাকর্তা, বেদ রতনের ভাই ব্রিগেডিয়ার কপিল মোহন। দাদার মৃত্যুর পর, ১৯৭০ নাগাদ, তিনি কোম্পানির হাল ধরেন, সেই থেকে ওল্ড মঙ্ক অন্য উচ্চতায় পৌঁছয়। গোলগাল, পেট মোটা, আটপৌরে বোতল, কোনও শৌখিনতার বাড়তি বালাই নেই, কিন্তু ঈষৎ কালো পানীয়ের মায়াজাদুতে আছন্ন গোটা দুনিয়া। আশ্চর্যের কথা আরও আছে, কপিল নিজে, কোনদিনও এক পাত্তরও গলাধঃকরণ করেননি, কখনও ধূমপান অবধি করতেন না। অথচ তিনি ভারতের তথা পৃথিবীর অন্যতম ‘লিকার ব্যারন’ ছিলেন। আর সেই সাতের দশক থেকে দু হাজার দশ অবধি, ওল্ড মঙ্ক ছিল এক নম্বর রাম, ভারতে নয়, বিশ্বজুড়ে, বিক্রি এবং জনপ্রিয়তার নিরিখে। আর এই এতগুলো দশকে, এবং আমৃত্যু তিনি একটা পয়সাও বিজ্ঞাপনে খরচ করেননি। বিজ্ঞাপন দেওয়াকে তিনি ‘বিলাসিতা’ বা অর্থের অপচয় ভাবতেন।
লেখা: সুশোভন প্রামাণিক
পাঠ: কোরক সামন্ত
আবহ: শঙ্খ বিশ্বাস