বড়বেলায় বড়পর্দায় ‘সোনার কেল্লা’ দেখতে বসা, আসলে এক কৌতূহলী কৈশোরের মুখোমুখি হওয়া। তবে, সেটুকুই সব নয়। নিছক কৌতূহল পেরিয়ে ফেলুদাকে পুনরাবিষ্কার করা যায় এই সূত্রেই। ধরা পড়ে এক যৌথতার আখ্যান। বিভাজিত আর বিভ্রান্ত সময়ে চেনা কাহিনিই হয়ে ওঠে অন্য এক দিকচিহ্ন।
লিখছেন, অর্পণ গুপ্ত।
পাঠ: শঙ্খ বিশ্বাস।
নন্দনের রুপোলি পর্দায় ‘সোনার কেল্লা’ (Sonar Kella) দেখতে দেখতে বারবার তাল কাটছিল। সামনের সিটে বসা বছর আটেকের কৌতূহলী দর্শক তখন বাবাকে অজস্র প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করছে; কিছু কিছু কানে এল- যেমন, ‘ডক্টর হাজরা কি মরে গেল?’, যেমন, ‘আফ্রিকায় কি সত্যিই নেকড়ে বাঘ থাকে?’ কিংবা ‘বাবা, টেলিপ্যাথি মানে কী?’ প্রশ্ন শুনে বড়পর্দার সামনে বসে থাকা এই বড় হয়ে যাওয়া আমি একটু বিরক্তই হচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল, বলি, কোনও প্রশ্ন নয়। আর ঠিক তখনই মনে পড়ল এক কিশোরের কথা, সেও তো ঠিক এই প্রশ্নগুলোই করেছিল মনে মনে।
বাচ্চাটির প্রতিটি প্রশ্নে জড়িয়ে থাকা অপার বিস্ময়ের কুচি এসে তখন মিশে যাচ্ছিল আমারই কৈশোরে; সে-কৈশোর যে হারিয়ে গেছে, সেই বিস্মরণের বোধও কমে এসেছে আজকাল। এই বছর আটেকের শৈশবের পাশে তখন মাঝবয়সে এসে পড়া আমার শৈশব বসতে চেয়েও বসতে পারছে না। শুধু ওর বিস্ময়ের গা ঘেঁষে বয়ে চলা যে তিরতিরে নদী, সেই জলে ডুব দিয়ে প্রাণপণে ফিরে পেতে চাইছে হারানো মতি।
অতএব, ফিরে আসি সোনার কেল্লায়। মন্দার বোসের মতো ভূগোলে ৫৬ পেয়ে ভণ্ড গ্লোবট্রটার না হলেও, তার অলীক সোনার কেল্লার পিছনে ছুটে বেড়ানোর পাগলামি মোটামুটি গিলে ফেলেছে একটা প্রজন্মকে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে, যেখানে দৌড়… দৌড় এবং কেবলই দৌড়ে চলার মাঝে আমরা কার্যত ভুলতে বসেছি জীবনের আসল উদ্দেশ্য, কোনওক্রমে বেঁচে থাকার ক্লান্তি ঢেকে দিচ্ছে প্রাণ ভরে বেঁচে নেওয়ার ইচ্ছে, সেখানে ‘সোনার কেল্লা’র (Sonar Kella) এই বড়পর্দায় ফিরে আসা আসলে এক আয়না।
গত পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে টেলিভিশনে কিংবা হালের বিভিন্ন ভিডিও প্ল্যাটফর্মে ‘সোনার কেল্লা’ (Sonar Kella) দেখেননি এমন বাঙালি বিরল। কিন্তু তারপরেও এই ছবির রিস্টোর্ড ভার্সন রি-রিলিজ হতে, বাঙালির উন্মাদনা তুঙ্গে। এই গরমে দুপুর দেড়টার সময়েও হাউসফুল। বাইরে পোস্টারে সেই বিখ্যাত লাইন- ‘সত্যজিত রায়ের সাংঘাতিক ছবি, সোনার কেল্লা’। সত্যজিৎ নিজে ‘সোনার কেল্লা’-কে আখ্যায়িত করেছিলেন কমেডি-থ্রিলার হিসেবে। উনিশ শতক থেকে বাংলায় থ্রিলার লেখা যা শুরু হয়েছিল, তার থেকে একবারে ভিন্নধারার গল্প লিখতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ।
‘সোনার কেল্লা’ মূল উপন্যাসে লালমোহন গাঙ্গুলি যখন কাহিনিতে এলেন, দেখা যায়, তিনি শরীরের মাসল অপেক্ষা ব্রেনের মাসলকে শক্ত করার পক্ষে। এখানে উনিশ শতকের শরীরচর্চায় উদ্বুদ্ধ বাঙালির, বিংশ শতকের মাঝামাঝি এসে কিঞ্চিৎ অলস হয়ে পড়া মধ্যবিত্ত বাস্তবতাকে এনেছেন সত্যজিৎ। আবার উল্টোদিকে, ফেলুদা নিয়মিত যোগব্যায়াম করেন, ক্রিকেট খেলেন, ফিজিক্যালি ফিট, মগজাস্ত্র শাণিত- অর্থাৎ বাঙালি যা চিরকাল হতে চেয়েছে, সেই ‘আইডিয়াল পৌরুষ’কে নির্মাণ করছেন সত্যজিৎ। আর গড়ে তুলছেন এই দুয়ের থেকে সমদূরত্বে থাকা এক কিশোরকে; তার সেই চিরজিজ্ঞাসু চোখ, যে-চোখ দিয়ে সত্যজিৎ দিব্যি মুছে ফেলেন, বাঙালির আদর্শবাদ ও বাস্তবতা- এই দুই জগতের মাঝে জমে থাকা কুয়াশা। তোপসে যখন ফেলুদাকে বলে, ‘তুমি যে বলো, টাকাটাই সবসময় বড় নয়…’, তখন, পণ্যায়ন-পূর্ববর্তী বিশ্বে বাঙালির অ-কিঞ্চিৎকর সমস্যার ঊর্দ্ধে, তার আদর্শের কাঠামোয় বাঁধা মনোলোকটি স্পষ্ট হয়। ‘সোনার কেল্লা’ (Sonar Kella) আসলে এই তিনটি লেন্সের সমাপতন; তিনজন মানুষের বন্ধুত্বকে সেলিব্রেট করার এই ধারণার জন্যেই ‘ফেলুদা’ কাহিনি হিসেবে অনন্য; আর এই বন্ধুত্ব আসলে এক বৃহত্তর যৌথতার কথাই মনে করিয়ে দেয়।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে একা টেলিভিশন বা মোবাইলে ‘সোনার কেল্লা’ দেখার যে অনুরণন, তা কয়েক হাজারগুণ বাড়িয়ে দেয় এই সকলে মিলে যৌথভাবে বসে এ-ছবি দেখা। জটায়ু পর্দায় আসা মাত্র, সাড়ে আটশো মানুষ একসঙ্গে হাততালি দিয়ে উঠছেন, ক্লাইম্যাক্সে ফেলুদা ভবানন্দের ভবের খেলা সাঙ্গ করে যখন বলে ওঠে ‘সাবাশ তোপসে’, তখন পাশাপাশি বসে থাকা কয়েকশো মানুষ যেন একসঙ্গে ফিরে যান কৈশোরের কোনও এক শেষ বল-এ ছয় মেরে জিতে যাওয়া পাড়া ক্রিকেটের মাঠে।
এই যে যৌথতার ধারণা, বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে মানুষে মানুষে বিভাজনরেখা যেখানে স্পষ্ট করে দিতে চাইছে রাজনীতি, ঠিক সেইখানটিতেই ফেলুদা-যাপনের (Sonar Kella), লালমোহনীয় ইচ্ছের, তোপসের সারল্যের তিনটি তন্ত্রী জুড়ে দিতে পারে বহুসংখ্যক মানুষকে। হোক না অপরিচিত, হয়তো সম্পূর্ণ অচেনা কয়েকশো মানুষের ভেতর বোনা আছে ভিন্ন রাজনীতি চেতনার নকশা… তবু পাশাপাশি বসে এই উদযাপনে আসলে সকলে বন্ধুই; এই ধারণাই সত্যজিৎ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন ‘ফেলুদা’-য়, যে-ধারণা অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে, শত হিংসা-ঘৃণা-বিভাজনের পরেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক আজও…