দেশের রাজনীতি আপাতত শ্রীরামচন্দ্রকে কেন্দ্র করে চূড়ান্ত উত্তপ্ত। দেশে তাঁর মন্দির নির্মিত হচ্ছে, তহবিলে জমা পড়েছে অন্তত হাজার কোটি টাকা। অনুদান দেওয়া বিষয়ে কিছু বলিউড সেলেব সরাসরি সাধারণ মানুষের কাছে আবেদন করেছেন, সেই নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। কর্নাটকের প্রাক্তন এক মুখ্যমন্ত্রী ক’দিন আগে অভিযোগ তুলেছেন, একটি হিন্দুত্ববাদী দল মন্দির নির্মাণ তহবিলে দান না করলে হুমকি দিচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতেই মনে পড়ে যায়, ভারতের অভ্যন্তরেই রয়েছে এমন এক জনগোষ্ঠীর বাস, যাঁদের রামভজনার জন্য আলাদা করে মন্দিরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। রাম তাঁদের শুধু আত্মায় নয়, ছড়িয়ে রয়েছেন সারা দেহজুড়ে, আক্ষরিক অর্থেই।
কীভাবে? বলছিই বা কাদের কথা?
ছত্তিশগড়ের জনজাতি রামনামী। এই জনগোষ্ঠীর মানুষের গোটা শরীরে, মুখে, মাথায়, এমনকী, অনেকের চোখের পাতায় পর্যন্ত লেখা থাকে রামের নাম! এঁদের বাস মহানদীর তীরবর্তী রায়গড়, জঞ্জগির-চম্পা, বিলাসপুর এবং অন্যান্য জনপদগুলিতে। ছত্তিশগড়ের বাইরে মহারাষ্ট্র, ওড়িশার কিছু সীমান্তবর্তী রয়েছেন এই রামনামীরা।
এঁদের সারা গায়ে অঙ্কিত উল্কি ধর্মীয় জাতপাতের বিরুদ্ধে যেন নীরব বিদ্রোহের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। একটা সময় মন্দিরে প্রবেশাধিকার ছিল না এঁদের। হিন্দু সমাজের সবচেয়ে নিচের সারিতে ছিল এই ‘অচ্ছুত’দের অবস্থান। কিন্তু ঈশ্বরলাভের জন্য মন্দিরের মূর্তিপূজা করতেই হবে, এমন মাথার দিব্যি কেউ তো দেয়নি। অতএব এঁরা সারা শরীরে ‘নির্গুণ’ রামের নাম খোদাই করতে শুরু করলেন। গায়ে দিতে শুরু করলেন রামনাম লেখা ওড়না। আর রোজ ‘রামচরিতমানস’ থেকে ভগবান রামের নাম দিয়ে দিন গুজরান করতে লাগলেন। এইভাবেই রামচন্দ্রর সঙ্গে এই জনগোষ্ঠীর সেতু গড়ে উঠল। সরকারি নথিপত্রে রামনামীরা হিন্দু হিসাবে তালিকাভুক্ত হলেও সঠিক সংখ্যা যথাযথভাবে অনুমান করা কঠিন। গোষ্ঠীর বয়োজ্যেষ্ঠদের অবশ্য দাবি, নারী–পুরুষ উভয়ের সংখ্যা লক্ষাধিক।
রামনামী সম্প্রদায়ের বয়স এক শতাব্দীর কিছু বেশি। ‘রাপ্ট ইন দ্য নেম: দ্য রামনামীস, রামনাম অ্যান্ড আনটাচেবল রিলিজিয়ন ইন সেন্ট্রাল ইন্ডিয়া’র লেখক অধ্যাপক রামদাস ল্যাম্ব জানিয়েছেন, ১৮২০ নাগাদ জাতিতে চামার একদল মানুষ রামনামী হয়ে ওঠেন।
মৃত জীবজন্তুর দেহ সৎকার এবং ছাল– চামড়া বিক্রি করেই তাঁরা জীবিকানির্বাহ করতেন। তাঁদের জাতের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া এই পেশা বর্জন করে তাঁরা কৃষিকাজ, মৃৎশিল্প, ধাতুশিল্প ইত্যাদি পেশা গ্রহণ করেন।
পঞ্চদশ শতকের আধ্যাত্মিক সাধক ছিল্ন সন্ত কবীর। কবীরপন্থীরা ধর্মীয় ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে নির্গুণের উপাসনার করার নিদর্শন রেখেছিলেন। তাঁর পদচিহ্ন ধরেই গুরু ঘাসিদাস সাতনামি সম্প্রদায়ের সূচনা করেন। অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, রামনামী সমাজ তৈরির নেপথ্যে সাতনামী আন্দোলনেরও ছায়া আছে।
কাহিনি এবং ইতিহাস অনুযায়ী এই সম্প্রদায়ের প্রাণপুরুষ ছিলেন পরশুরাম ভরদ্বাজ নামের একজন নিম্নবর্গীয় হিন্দু। জাতিতে চামার। জন্ম জঞ্জগির-চম্পা জেলার চারপোরা গ্রামে। পেশায় ভাগচাষি। ছোট থেকেই রামায়ণের গল্প তাঁকে অনুপ্রাণিত করত। নিজেকে স্বশিক্ষিত করেছিলেন যাতে রামায়ণের গল্প পড়তে এবং সেগুলোর ব্যাখ্যা লিখতে পারেন। স্থানীয় কাহাবত অনুযায়ী, পরশুরাম কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হন। সামাজিক রীতি মেনে তাঁকে একঘরে করা হয়। নিজেও নিজেকে সরিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। সেই সময়েই পেয়েছিলেন এক সাধুর দর্শন। সাধু তাঁকে ভক্তিভরে রামায়ণ পাঠ করতে বলেন। সাক্ষাাতের পরদিন সকালে পরশুরাম আবিষ্কার করেন, তাঁর শরীর থেকে রোগ দূর হয়েছে এবং তাঁর বুকে রামের নাম লেখা একটি উল্কি আঁকা। গ্রামবাসীরা তাঁকে ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য ভাবতে শুরু করেন। শুরু করেন মান্যতা দিতেও। পরশুরাম তাঁদের রামকথার মাহাত্ম্য বোঝান। পড়তে বলেন রামায়ণও। পরামর্শ দেন নিয়মিত রামনাম করার।
তারপর? শুনুন…
লেখা: সুশোভন প্রামাণিক
পাঠ: শঙ্খ বিশ্বাস
আবহ: শঙ্খ বিশ্বাস