২০২০–র ২৮ ডিসেম্বর মারা যান মা। ১০ দিনও কাটেনি প্রয়াণের। স্মৃতি আর শোকের চাপ–চাপ বাষ্প এখনও জাঁকিয়ে বসে চেন্নাইয়ের কোদামবক্কমের হাবিবুল্লা রোডের বাড়িটিতে। তাই এই জন্মদিন কোনও উৎসব বা উদ্যাপনে নয়; কাটবে শুধুই প্রার্থনায়। মা করিমা বেগমের স্মৃতিটুকু আঁজলা ভরে রেখে তাতে মৌনতার সুর মেশাবেন সংগীতসম্রাট এ. আর. রহমান। তাও বাড়ি থেকে দূরে। ‘হি ইজ নট সেলিব্রেটিং হিজ বার্থডে’––– টিম ‘শোনো’কে এমনটাই জানালেন রহমানের ম্যানেজার। বছরকার এই দিনটিতে এবার পরিবার–সহ আউট অফ টাউন রহমান। এমনিতে জন্মদিন সেলিব্রেট করেন মায়ের সঙ্গেই। এই প্রথম কোনও জন্মদিনে মা নেই। তাই বাড়িতে আর মন টেকেনি সুরসম্রাটের। শুভ দিনটিতে ঐকান্তিকভাবে মাতৃস্মরণ যেন অস্কারজয়ী সুরকারের নিজেকে নিজের দেওয়া মহার্ঘ্য উপহার। সযত্নে রাখার মতোই।
‘মোৎজার্ট অফ মাদ্রাজ’। হ্যাঁ, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংগীতমহলে এককথায় এই নামেই ডাকা হয় এ. আর. রহমানকে। এহেন রহমানের মাতৃভক্তি ছিল দেখার মতো। রহমানই প্রথম এশীয় যিনি একই বছরে একসঙ্গে দু’টি অস্কার জেতেন: ‘স্লামডগ মিলিয়নেয়ার’–এর ‘বেস্ট অরিজিন্যাল স্কোর’–এর জন্য এবং সংশ্লিষ্ট সিনেমাটিরই গান ‘জয় হো’ গেয়ে ‘বেস্ট অরিজিনাল সং’–এর জন্য। ১২ বছর আগে অস্কারের মঞ্চে উঠেও মাকে স্মরণ করেছিলেন। সোচ্চারে। সগর্বে। বলেছিলেন, ‘মেরে পাস মা হ্যায়… হার ব্লেসিংস আর উইথ মি।’ এ.আর.–এর জন্মদিনে আসু্ন শুনে নেওয়া যাক মা–ছেলের সেই নিটোল স্নেহের কিস্সা।
রহমানের অন্যতম ক্লাসিক ‘মা তুঝে সালাম’। যেখানে যতবার ‘মা তুঝে সালাম’ গেয়েছেন, স্মরণ করেছেন মাকে। নিজেই জানিয়েছেন, “দেশাত্মবোধ কাজ করবে কি করবে না, করলেও কীভাবে করবে––– সেই নিয়ে সংশয়ী ছিলাম বরাবর। নিজেকে বলেছিলাম, আপাতত দেশের কথা থাক; ভাবো, গানটা যেন বানাচ্ছ কোনও প্রিয়জনকে নিয়ে। যেন কেউ কারও মায়ের জন্য বানাচ্ছে। গাইছে। এইভাবেই ‘মা তুঝে সালাম’ তৈরি হল।”
দেশ হোক কি বিদেশ, পুরস্কার মঞ্চ কিংবা স্টেজ প্রোগ্রাম, স্টুডিও বা নিভৃত যাপন––– মা কায়িকভাবে পাশে না–থেকেও বরাবর থেকেছেন ছেলের সঙ্গে। রহমানের স্বগতোক্তি, ‘আমি নই, আমার মা–ই প্রথম আবিষ্কার করেন আমার সংগীতপ্রতিভার দিকটি। কম্পোজারদের বিভিন্ন যন্ত্রানুসঙ্গের বন্দোবস্ত করে দিতেন বাবা আর. কে. শেখর। তাঁদের অনেকের কাছেই তাই তিনি ‘ম্যান ফ্রাইডে’ বলে সুপরিচিত। কর্নাটকের সেইসব সংগীতকাররা গানের কথা লিখে দিতেন, আর বাবা তাঁদের সাহায্য করতেন সমস্ত রকম যন্ত্রের জোগান দিয়ে। একসঙ্গে আটজন কম্পোজারের সঙ্গে বাবা কাজ করছেন, এরকমও হয়েছে। দিনরাত খেটে চলতেন। এহেন মানুষটি মারা যাচ্ছেন আমার ন’বছর বয়সে। তাঁর মৃত্যুর পাঁচ বছরও পর মা বাড়িভাড়া দিতেন বাবার গান–বাজনার যন্ত্রগুলো ভাড়া খাটিয়ে। একবার মায়ের কাছে প্রস্তাব আসে, সেগুলো বিক্রি করে দিয়ে নগদ অর্থ নিয়ে সুখে দিন কাটানোর। মা সেবার খুব রেগে যান। তাঁদের সাফ জানান, ‘ওগুলোর দেখভাল করার জন্য আমার ছেলে আছে। তোমাদের ভাবতে হবে না।’
লেখা: সোহিনী সেন
পাঠ: সুশোভন প্রামাণিক, শ্যামশ্রী সাহা
আবহ: শুভাশিস চক্রবর্তী