রাবণহত্তা যন্ত্রটি নারকেলমালার সঙ্গে বাঁশের ডগা জুড়ে বানানো। ১৫টি ধাতব পেরেক গোত্রীয় জিনিস দিয়ে জোড়া থাকে জিনিস দু’টি। নারকেলমালার আস্তরণ তৈরি হয় ছাগলের চামড়া দিয়ে। আর যন্ত্রের তার তৈরি হয় ঘোড়ার লেজের চুল দিয়ে। একটি কাঠের হেলা দিয়ে এটিকে বাজানো হয়। যন্ত্রের এই নির্মাণশৈলীর সঙ্গেও জুড়ে রয়েছে মিথ। ১৫টি ধাতব পেরেক আসলে রাবণের ১৫টি আঙুল। নারকেলমালার পিছনে থাকা দুই কাঠের পেরেক রাবণের দুটি বুড়ো আঙুল। নারকেলমালা ওঁর কাঁধকে উপস্থাপনা করে, যন্ত্রের তারগুলি কল্পিত হয় ওঁর স্নায়ু হিসাবে।
মিথ এবং কিংবদন্তির কুয়াশা সরিয়ে রেখেও যন্ত্রটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব কিন্তু অস্বীকার করা যায় না। তাই মিউজিকলজিস্ট এবং ইতিহাসবিদরা এই নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন যথেষ্ট। অনেক ইতিহাসবিদ আবার বলেন, বেহালার উৎপত্তি আদতে এই যন্ত্র থেকেই। সংগীতের ইতিহাস বিষয়ক যেসব বই উনিশ ও বিশ শতকে প্রকাশিত হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম উইলিয়ম স্যান্ডি’র লেখা ‘হিস্ট্রি অফ ভায়োলিন’ এবং জিওফ্রে এলওয়েন এর লেখা ‘দ্য ভায়োলিন এন্ড ইটস স্টোরি’ সেখানেই দু’জনেই এক মত জানিয়েছেন। দু’জনেরই বক্তব্য যে, রাবণস্ত্রোম বা রাবণহত্তা আদতে আধুনিক বেহালার প্রাচীন পূর্বপুরুষ।
মধ্যযুগের ভারতীয় ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, রাজারাই ছিলেন সংগীতের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। রাজস্থান এবং গুজরাত এই দুই রাজ্যেই রাজপরিবারের সন্তানদের প্রথাগত সংগীতশিক্ষার প্রারম্ভে যে–যন্ত্র শেখা বাধ্যতামূলক ছিল সেটি এই রাবণহত্তা। পরবর্তী সময়ে রাজস্থানের ‘সংগীত-পরম্পরা’ এই যন্ত্রকে মহিলাদের মধ্যেও যথেষ্ট জনপ্রিয় করে তোলে।
সপ্তম থেকে দশম খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আরবের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এদেশে বাণিজ্য করতে আসে। এখান থেকেই তারা এই যন্ত্রটি নিয়ে পাড়ি দেয় তাদের দেশে। এই যন্ত্র থেকেই আরবীয় প্রথাগত বাদ্যযন্ত্র ‘রবাব’ গড়ে উঠেছিল, যা বেহালাগোত্রীয় যন্ত্র–পরিবারের অংশ এবং পূর্বসূরি।
প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, রাবণহত্তার প্রথম লিখিত উল্লেখ পাওয়া যায় প্রসিদ্ধ পণ্ডিত নান্যাদেবের সংগীত ও ইতিহাস বিষয়ক বই ‘ভারতভাষ্য’-এ। এই পণ্ডিতের বাসস্থান অবশ্য পশ্চিম ভারত ছিল না, তিনি ছিলেন বিহারের মিথিলার বাসিন্দা। সতোরো শতকের তামিল মহিলা কবি রামাভদ্রাম্ভার লেখায় রাবণহত্তার উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি জানিয়েছিলেন, তাঞ্জোরের রাজসভায় কোনও এক মহিলা সংগীত-শিল্পী অপরূপ সুরে এই যন্ত্র বাজাচ্ছিলেন।
লেখা: সুশোভন প্রামাণিক
পাঠ: শ্যামশ্রী সাহা
আবহ: শঙ্খ বিশ্বাস