“দেশের বড় মঙ্গল— তোমরা একবার মঙ্গলের জন্য জয়ধ্বনি কর!
এই মঙ্গল ছড়াছড়ির মধ্যে আমার একটি কথা জিজ্ঞাসার আছে, কাহার এত মঙ্গল? হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্ত দুই প্রহরের রৌদ্রে, খালি মাথায়, খালি পায়ে এক হাঁটু কাদার উপর দিয়া দুইটা অস্থিচর্মবিশিষ্ট বলদে, ভোঁতা হাল ধার করিয়া আনিয়া চষিতেছে, উহাদের কি মঙ্গল হইয়াছে?”
বঙ্গদেশের কৃষকদের কথা বলতে বসে এই মৌলিক প্রশ্নটি তুলেছিলেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আজ থেকে প্রায় ১৩০ বছর আগে। গঙ্গা দিয়ে তারপর অনেক জল বয়ে গিয়েছে। কৃষি আর কৃষকদের নিয়ে আবর্তিত হয়েছে দেশের রাজনীতির নানা পর্ব। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বারবার প্রাধান্য পেয়েছে ভারতবর্ষের কিষাণ চাষার কথা। প্রান্তের সারিতে দাঁড়িয়েও বারংবার কেন্দ্রকে নাড়া দিয়েছেন তাঁরাই— তাঁদের কথা উঠে এসেছে সাহিত্যের পাতায়, সাংবাদিকের কলমে, রাজনীতির স্লোগানে। কৃষক আর তাঁর জমির আন্দোলনের মাটি থেকে উঠে এসেছে বহু নেতা, মন্ত্রী আর রাজনীতির কুশীলবরা। কিন্তু, ‘উহাদের কি মঙ্গল হইয়াছে?’ প্রশ্নটি রয়ে গিয়েছে আজও। মঙ্গল বলুন বা ‘উন্নয়ন’ কিংবা ‘বিকাশ’ – শব্দগুলো ইদানিং বড় বেশি ‘কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিতে চায়’। কিসে ভালো আর কিসে খারাপ— সে বিচার শেষপর্যন্ত মানুষের হাতে, সময়ের হাতে। কিন্তু ইতিহাস বলছে ভারতবর্ষের রাজনীতি থেকে সমাজনীতি— অর্থনীতি থেকে সংস্কৃতি—বারবার আবর্তিত হয়েছে কৃষক শ্রমিকের ঘাম-রক্ত-অস্থি-মজ্জা-মেহনতের সমীকরণে।
ইংরেজ আমল থেকে ইতিহাসের চাকা গড়িয়ে দিলে দেখা যাবে জমিদারী ব্যবস্থার এক ভিন্নধর্মী চেহারার গড়ে উঠেছিল। তবে কিনা ইতিহাসেরও ইতিহাস থাকে, তাই জমিদার আর কৃষকের কাহিনির শুরুয়াৎ ইংরেজ আমলে নয়, তারও বহু বহু আগে। আর কে না জানে ‘জীবের শত্রু জীব, মনুষ্যের শত্রু মনুষ্য; বাঙ্গালী কৃষকের শত্রু বাঙ্গালী ভূস্বামী” – প্রজাপীড়ন , জোর করে চাষ করানো, খাজনা আদায়ের জন্য অত্যাচার— এইসবই চিরাচরিত সত্যের মতো যুগ যুগ ধরে নতুন নতুন চেহারায় সামনে এসেছে। আর মার খাওয়া কৃষক-সমাজ নানা-সূত্রে নানা বিদ্রোহের আগুন ফেটে পড়েছে সময়ের পথে পথে। এর মধ্যে নীলবিদ্রোহ ইতিহাস প্রসিদ্ধ। এই নীল চাষের ফলেই বঙ্গদেশ ও বিহারের কৃষকেরা ভূমিদাসে পরিণতি হয়েছিল। নীল বিদ্রোহের ইতিহাস একদিকে যেমন জন্ম দিয়েছে রুখে দাঁড়ানো লড়াইয়ের, অন্যদিকে সাহিত্যের পাতায় তাঁকে চিরকালের দর্পণে ধরেছেন দীনবন্ধু মিত্র— নীলদর্পণ নাটকে। নাটকের মূল চরিত্র ক্ষেত্রমণি আর তোরাপ, জীবনযুদ্ধে বাস্তবে হয়ে উঠবে অসংখ্য। পরবর্তী প্রজন্ম যে দর্পণ থেকেই চিনে নেবে নিজেকে, চিনে নেবে শত্রুকেও। বঙ্কিম থেকে দীনবন্ধু। রবীন্দ্রনাথ থেকে নজরুল। সুকান্ত থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায় হয়ে মহাশ্বেতা দেবীর প্রতিবাদী কলম; নীল বিদ্রোহ থেকে অসহযোগ। আইন অমান্য থেকে ভারত ছাড়ো। তেভাগার ‘হেই সামালো’ থেকে সত্তরের ভূমি সংস্কার— কাকদ্বীপ থেকে নকশালবাড়ি, কিংবা সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পেরিয়ে হরিয়ানা পাঞ্জাব থেকে দিল্লির পথে পথে ডিসেম্বর ২০২০, ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে হয়তো, আর এসে বারবার প্রশ্ন করে ‘উহাদের কি মঙ্গল হইয়াছে?’
সাহিত্যে গানে কবিতায় স্মৃতির তোরণ ডিঙিয়ে, তেভাগা থেকে সত্তর দশক হয়ে বর্তমানের ভারতের দিকে আমাদের ফিরে দেখা। শুনুন…
ছবি: চিত্তপ্রসাদের তেভাগা আন্দোলনের সময়ে আঁকা উডকাট অবলম্বনে।
লেখা: সানু ঘোষ ও সুশোভন প্রামাণিক
পাঠ: শ্যামশ্রী সাহা, সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুশোভন প্রামাণিক, মৌমিতা সেন ও শঙ্খ বিশ্বাস
আবহ: শঙ্খ বিশ্বাস
যন্ত্রানুষঙ্গ: শঙ্খ বিশ্বাস