‘তুমি কেমন গাড়ি চালাতে পারো?’
‘এই একরকম মোটামুটি ভালই পারি।’
‘কখনো লং ডিসট্যান্স গাড়ি চালিয়েছ?’
‘না।’
‘দেখ, একদিন রাতে তোমাকে গাড়ি করে আমাকে বেশ কিছু দূরে পৌঁছে দিতে হবে, পারবে?’
‘কেউ কিছু জানবে না।’
‘ঠিক আছে।’
ওপরের কথাবার্তায় প্রশ্ন করছেন সুভাষচন্দ্র বসু। উত্তরদাতা শিশিরকুমার বসু, সুভাষচন্দ্রের ভাইপো। কিছুদিনের জন্য, বিশেষ কারণে হারিয়ে যাওয়ার বিশেষ পরিকল্পনার সেই শুরু। কিছুদিন বলতে সুভাষের হিসেব ছিল বছর কুড়ি, ভেবেছিলেন এর মধ্যেই তাঁর নিজস্ব পথ ও প্রক্রিয়ায় ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে পারবেন, তাই ‘সময় কাটিয়ে বৃথা সময় বিচার’ না–করে ‘নির্ভাবনায় ঝাঁপ দিয়ে’ পড়লেন ‘অজানিতের পথে’।
তবে ভাবনাতে ‘ঝড়ের হাওয়া’ লাগিয়ে নিরুদ্দেশের পথিক হওয়ার বাসনার জন্ম হয়েছিল তাঁর শেষ জেলবাসের সময়। মহানিষ্ক্রমণের সঙ্গে যেহেতু ব্যাপারটা অনেকটাই জড়িয়ে, তাই শুরুয়াতটা একটু বলে নিতে হবে।
২ জুলাই ১৯৪০। দুপুরবেলা। তখনকার ডেপুটি কমিশনার মি. জানভ্রিন ভারত–রক্ষা আইনের ১২৯ ধারায় নেতাজি’কে গ্রেপ্তার করে প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে গেলেন। সুভাষ সেখানে সঙ্গী হিসেবে পেয়ে গেলেন বি ভি–র হেমচন্দ্র ঘোষ, সত্য বক্সী, মণীন্দ্র রায় প্রমুখ নেতাকে। মন্ত্রণা শুরু হল, সকলে একবাক্যে রায় দিলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি’–তে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুভাষকে জেলের বাইরে যেতে হবে।
তখনকার ‘বর্তমান পরিস্থিতি’ ছিল এইরকম: ফরাসিরা জার্মানদের কাছে গোহারান হেরে গিয়েছে। ইউরোপে যুদ্ধের অবস্থা ক্রমশ ঘোরালো হয়ে উঠেছে। মিত্রশক্তি একটার–পর–একটা যুদ্ধ হেরে এমন অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যে, ইংল্যান্ড ছাড়া কোথায় তাদের দাঁড়ানোর জায়গা অবধি নেই। এরকম একটা অবস্থায় যদি রাশিয়া, জার্মানি কিংবা ইতালি––– যে কোনও একটা দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের সাহায্যে একটা জাতীয় সেনাবাহিনীকে নিয়ে ব্রিটিশের এপর ঝাঁপিয়ে পড়া যায়, তা হলে তারা ভারতবর্ষ ছাড়তে বাধ্য হবে। এই যোগাযোগের জন্য সুভাষের বাইরে থাকা প্রয়োজন, এমনটাই ভাবলেন জেলে থাকা নেতৃবৃন্দ।
এ ভাবনা অবশ্য সুভাষচন্দ্রের আগে থেকেই ছিল। তাঁর চিরকালীন মত ‘ইংল্যান্ডের বিপদ মানেই ভারতের সুযোগ’। বেশ কয়েকজন জাতীয় নেতার সঙ্গে এখানেই ছিল তাঁর চিন্তার ফারাক। কে বা কারা ঠিক ছিলেন এ–নিবন্ধে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। এখানে সুভাষের নিজস্ব অনুভবের কথা বলব। তিনি বলেছেন, বাঁধা রাস্তার বাইরে অজ্ঞেয়–র সন্ধানে যে–অভিযাত্রী জীবন, সে–জীবনই তাঁকে বেশি করে টানে। যা হোক, সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর দ্রুত কাজ শুরু করে দিলেন সুভাষ।
তারপর শুনুন…
লেখা: বিকাশ মুখোপাধ্যায়
পাঠ: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুশোভন প্রামাণিক