বেগম জনসন তাঁর জীবনে অনেক কিছু দেখেছিলেন। অতীতের সেইসব ঘটনা গল্পের ছলে তিনি বলে যেতেন, অবিরল।
কী কী দেখেছিলেন বেগম জনসন?
দেখেছিলেন, বর্গি আক্রমণের কারণে কলকাতায় তীব্র খাদ্যাভাব শুরু হয়। নবাব আলিবর্দি অত্যাচার থেকে দেশকে বাঁচিয়েছিলেন। ১৭৫৬ কলকাতার ব্ল্যাক জমিদার গোবিন্দরাম মিত্রর ছেলে রাধাচরণ এর ফাঁসি দেখেছিলেন তিনি। দেখেছিলেন ফোর্ট উইলিয়ম আক্রমণ। লালদিঘির যুদ্ধ। অন্ধকূপ হত্যা। কলকাতায় মহামারীর শুরুয়াত। ক্লাইভের কলকাতা আগমন। কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হওয়া। রেস কোর্সের কাছে কুলি বাজারে মহারাজা নন্দকুমারের ফাঁসি। কলকাতায় রাজভবনের সূচনা ও লর্ড ওয়েলেসলির বড়োলাট হওয়া। আলিবর্দি খান, সিরাজ দু’জনকেই দেখেছেন। এছাড়াও শোনাতেন নানিবেগমের সঙ্গে তাঁর স্নেহ ও শ্রদ্ধার সম্পর্কের কথা। আলিনগরের জেনানামহলের গল্প ও স্মৃতি আজীবন তাঁর স্মৃতিতে ছিল অমলিন। ফ্রান্সিস তো এছাড়াও দেখেছেন হেস্টিংসের ডুয়েল। এমনকী দেখেছেন শহরে ঘোড়ার গাড়ির প্রচলনও।
এই গল্পের আসরে সাহেব–নেটিভ দু’পক্ষই উপস্থিত থাকতেন। অজস্র কাহিনির সঙ্গে খানাপিনা আর হুঁকোর মৌতাত জমে উঠত। অনেকেই বেগমের বাচনশৈলীর ভূয়সী প্রশংসা করতেন। তাঁকে মুড়ে ফেলতেন উদার স্তব ও স্তুতিতে। সেসব শুনে বেগমের রাঙা মুখ রক্তিম ডালিমের মতো হয়ে উঠত। অনেকেই গোপনে বেগমের পাণিপ্রার্থী ছিলেন, বেগম সে কথা জানলেও আমৃত্যু আর বিবাহ করেননি।
এভাবে দীর্ঘ ৮৭ টি রঙিন বসন্ত পার করে চিরকালের মতো চোখ বুজলেন তিনি। সারা জীবন ধরে সকলের কাছেই পেয়েছিলেন ভালবাসা, সন্মান ও মর্যাদা। মৃত্যুর পরেও তার অন্যথা হয়নি। তাঁর শেষকৃত্যে উপস্থিত ছিলেন কলকাতার সমস্ত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, কাউন্সিলের সদস্যরা, সুপ্রিমকোর্টের জর্জ, এমনকী, ছয়-ঘোড়ার গাড়িতে চেপে এসেছিলেন বড়োলাট মিন্টোও! সঙ্গে ফোর্ট উইলিয়ামের একদল রেজিমেন্ট। এমন রাজকীয়ভাবে কোনও নাগরিকের শেষকৃত্য এর আগে কলকাতার ইতিহাসে কোনওদিন অনুষ্ঠিত হয়নি।
বেগমের ইচ্ছা ছিল, সেন্ট জনস চার্চে তিনি চিরঘুমে শুয়ে থাকবেন। সেই অনুমতি আদায় করেছিলেন বড়লাট ওয়েলেসলির থেকে। তাঁর মৃত্যুর সময়ে সেন্ট জনস চার্চে সমাধি দেওয়া বন্ধ হয়েছে। কিন্তু তৎকালীন বড়লাট লর্ড মিন্টো বেগমের এই শেষ ইচ্ছে রেখেছিলেন।
লেখা: সুশোভন প্রামাণিক
পাঠ: শ্যামশ্রী সাহা ও সুশোভন প্রামাণিক
আবহ: শঙ্খ বিশ্বাস