তখন সবে মাত্র জন্মেছে শহর, কালের বিচারে শিশু হলেও বয়ঃপ্রাপ্তের উপাচারে ছেয়ে গিয়েছে তার অলি-গলি, দেহের পসরার বিকিকিনির বাজার গড়ে উঠেছে সোনাগাছি আর রুপোগাছির চত্বরে, আর বাগবাজার বৌবাজারের খ্যাতি নেশার কৌলীন্যে, সেকালের ছড়াতেই ছিল তার প্রমাণ:
বাগবাজারে গাঁজার আড্ডা, গুলীর কোন্নগরে;
বটতলায় মদের আড্ডা, চণ্ডুর বউবাজারে,
এইসব মহাতীর্থ যে না চোখে হেরে
তার মত মহাপাপী নাই এ সংসারে।
‘মহাতীর্থ’ই বটে! কলকাতার সেযুগের নেশাড়ু সমাজে বাগবাজারের গাঁজাড়ু আর বৌবাজারের চণ্ডুখোরেরা ছিল কৌলীন্য সম্মানের প্রাপক, সমাজে তাঁদের বেশ খ্যাতিও ছিল।
কলকাতা ছিল তখন পাখিদের দখলে। যে সে পাখি নয়, মানুষ-পাখি, যারা গান গাইত, পাখির ভাষায় কথা বলত, এমনকি ডানা মেলে আকাশে উড়তেও পারত—অবশ্যই ছিলিম ছিলিম গাঁজা টানার পর।
বাগবাজারের গাঁজার আড্ডা ও পক্ষীর দলের সৃষ্টি করেছিলেন দেওয়ান দুর্গাচরণ মুখোপাধ্যায়ের বড়ো ছেলে শিবচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ওরফে শিবু ঠাকুর, রাজা নবকৃষ্ণের দেবের ‘ইয়ার’ ছিলেন তিনি। তাঁরই তত্ত্বাবধানে বাগবাজারের পাবলিক আটচালায় নিয়মিত গেঁজেলদের আড্ডা বসত। এখানেই গাঁজা টানার পারদর্শিতার উপরে নির্ভর করে এক একজন গাঁজাড়ু এক একরকম পাখির নাম পেতেন আর সারাজীবন ধরে সেই পাখির হাবভাব আচার আচরণ অনুকরণ করে যেতেন। এরকমই আরেকটি প্রসিদ্ধ আটচালা ছিল শোভাবাজার বটতলার কাছে, এখানে পক্ষীর দলের নেতৃত্ব দিতেন বাবু রামনারায়ণ মিশ্র।
ঈশ্বর গুপ্ত এই পক্ষীর দল প্রসঙ্গে লিখেছেন, “এই পক্ষীদলের পক্ষী সকলেই ভদ্রসন্তান ও বাবু এবং সৌখীন নামধারী ছিলেন। পাখির দলেরা নিধুবাবুকে কর্তা বলিয়া অত্যন্ত মান্য করিত।”
এই নিধুবাবু ছিলেন সেকালের টপ্পার বিখ্যাত গায়ক রামনিধি গুপ্ত।
তবে পক্ষী হওয়া মোটেই সহজ ব্যাপার ছিল না। রীতিমতো পরীক্ষা দিতে হত, গাঁজা টানার পরীক্ষা। পক্ষী হওয়ার ইচ্ছে নিয়ে কেউ আটচালায় এলে অ্যাডমিশন টেস্ট হিসেবে গাঁজা টানতে হত—ছিলিমের পর ছিলিম, না-কেশে একবারে যে ১০৮ ছিলিম গাঁজা টানতে পারবে তাকেই পক্ষীদলের অন্তর্ভুক্ত করা হত, সেই সঙ্গে দেওয়া হত একটি স্মারক ইট। এইভাবে যে মহাপুরুষ প্রতিবার ১০৮ ছিলিম গাঁজা টেনে একটি একটি করে ইট জমিয়ে সেই ইট দিয়ে একটা পুরো চার দেওয়ালের ঘর বানাতে পারবে তিনিই হবেন পক্ষীরাজ — পক্ষীকূলের শ্রেষ্ঠপুরুষ। কলকাতায় মাত্র দেড়জন এই গেঁজেল ইটের স্বর্গ নির্মাণ করতে পেরেছিলেন — পটলডাঙার রূপচাঁদ পক্ষী আর বাগবাজারের হাফ নিতাই পক্ষী — বেচারা নিতাই গেঁজেল ইটের চার দেওয়ালখানা তোলার পর পরই অক্কা পেয়ে যায়, ফুল পক্ষীর শিরোপা তাই তাঁর জোটেনি। নিতাইের কথা উঠলেই রূপচাঁদ তাই দুঃখ করে বলত, ‘ছোকরার এলেম ছিল, অকালে না মরলে একটা আস্ত পক্ষী হতে পারত’।
লেখা: সানু ঘোষ
পাঠ: দেবাঞ্জন মিত্র
আবহ: শঙ্খ বিশ্বাস