শোনা যায় প্রায়দিনই নিঝুম দুপুর কি সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ির সামনের বনপথকে মথিত করে, শুকনো পাতায় শব্দ তুলে একখানা চারঘোড়ায় টানা অদৃশ্য জুড়িগাড়ি এসে থামে হেস্টিংস হাউস-এর গাড়ি-বারান্দার নিচে। লাট সাহেবের ভূত বলে কথা। অতএব তেমনই তাঁর দাপট!
খটাং করে দরজা খুলে তাঁর থেকে নামেন, গাড়ি থেকে মাটিতে পা রাখার প্রথম পদক্ষেপের সেই বুটের শব্দও নাকি স্পষ্ট শোনা যায়। তারপর সেই বিশাল প্রাসাদের প্রতিটি ঘর তন্ন তন্ন করে কি জানি খুঁজে বেড়ান হেস্টিংস সাহেবের অদৃশ্য অবয়ব। কোনও মহামূল্যবান বস্তু কি তিনি ওই বাড়িতে ফেলে গিয়েছিলেন? যার খোঁজেই প্রেতলোক থেকে তাঁর এই নিত্য ছুটে আসা?
সেকালের লোকজন অবশ্য বলত অন্য কথা, “হবে না, সামান্য কারণে নন্দকুমারের মতো ব্রাহ্মণসন্তানের ফাঁসির হুকুম দিয়ে দিলেন, সেই পাপ কি এমনই যাবে! দুটো গির্জে গড়ার চাঁদা দিলেই বুঝি ব্রেহ্মহত্যার পাপ ধুয়ে যায়! যেনে রাখো, ও পাপের মুক্তি নেই!”
এখন এসব কাহাবতকে নিছক জনশ্রুতি বলে উড়িয়ে দেওয়াই যায়, কিন্তু সেই ইংরেজ আমল থেকে শুরু হয়ে বর্তমান সময় পর্যন্ত— হেস্টিংস হাউসকে ঘিরে এত মানুষের এত অভিজ্ঞতা হয়েছে যে ‘সব ঝুট হ্যায়’ বলে দেওয়ার মতো হিম্মত হয়না। শোনা যায় জুড়িগাড়ি হাঁকিয়ে তাঁর সেই আসার কথা শুনে রীতিমতো ভড়কে গিয়েছিলেন আরেক ক্ষমতাবান ইংরেজ সাহেব— লর্ড কার্জনও। তাঁর মতো জাঁদরেল পুরুষও বলেছিলেন ‘হেস্টিংস সাহেবকে না ঘাঁটানোই ভালো’—। জানা যায় কার্জনের সাহেবের থাকার বন্দোবস্ত একসময় করা হয়েছিল তাঁরই পূর্বসূরির এই বাড়িটিতে, কিন্তু জনশ্রুতির খবর তাঁর কানে গিয়ে পৌঁছলো। তারপর সেখানে গিয়ে পাহারাদারদের সঙ্গে কথা বলে কার্জন সাহেবের সভয় ঘোষণা করেছিলেন— যেখানেই হোক থাকব, কিন্তু হেস্টিংস হাউসে থাকব না।
সেই থেকে কেউই এখানে থাকেনি, থাকেনা। কালীঘাটের ছোটো গঙ্গা, মানে আদি গঙ্গার পারে এক সময় ছিল বিস্তীর্ণ বস্তি এলাকা, এখনও তার খানিকটা আছে বর্তমান। এককালে সমগ্র এলাকাটাই ছিল জঙ্গল আর বস্তি। তারই খানিকটা উচ্ছেদ করে হেস্টিংস বানিয়েছিলেন তাঁর এই বিশাল হৌস। একান্তই তাঁর নিজের, আর কারও নয়। ব্রিটিশ সরকারের পরবর্তী রথী-মহারথীরাও এড়িয়ে গিয়েছেন এই বাড়িটিকে। বদলে নেটিভ কেরানিদের ঠেলে দিয়েছেন সেখানে, এককালে আপিস হয়েছে বাড়িটির কিছু অংশে। এখন অবশ্য বাড়িটির খানিক অংশে রয়েছে মেয়েদের স্কুল, মেয়েদের বি এড কলেজ। তাঁদের মুখে মুখেও আজও ছড়িয়ে চলেছে দুপুর-রাতে হেস্টিংস সাহেবের হন্যে হয়ে কিছু এক অমূল্য জিনিস খুঁজে ফেরার কাহিনি—
লেখা: সানু ঘোষ
পাঠ: সুশোভন প্রামাণিক ও শঙ্খ বিশ্বাস
আবহ: শঙ্খ বিশ্বাস